সর্দার উধম
কাস্টিং: ভিকি কৌশল, অলম পরাশর, বনিতা সান্ধু
পরিচালক: সুজিত সরকার
রেটিং: ৪/৫
প্রথমেই একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, যাঁদের ডকুমেন্টারি ধাঁচে শুধুমাত্র বাস্তবের উপর ভিত্তি করে তৈরি সিনেমা পছন্দ তাঁরা এটা অবশ্যই দেখুন। যাঁদের পছন্দ নয়, তাঁরাও দেখুন, কারণ এই সিনেমায় জালিয়াঁওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা দেখানো হয়েছে, তেমন ডিটেলিং ভারতীয় সিনেমায় এর আগে দেখানো হয়নি।
এর পর আসা যাক মূল রিভিউতে। সর্দার উধম সিং (Sardar Udham Singh)। অনেকেই হয়তো নামটির সঙ্গে এই সিনেমার মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত পরিচিত ছিলেন না। কেন? শহীদ ভগৎ সিংকে (Bhagat Singh) নিয়ে সঙ্গত কারণে যে প্রচার এবং সম্মান ভারতীয়দের মধ্যে রয়েছে, তাঁর একান্ত সহযোগী, বয়সে সামান্য বড় বন্ধু শের সিং, ওরফে উদে সিং, ওরফে উধম সিং সম্পর্কে মানুষ এত কম জানেন কেন, তা জানতে গেলে সিনেমাটি দেখতে হবে। ভগৎ সিং, রাজগুরু এবং শুকদেবের ফাঁসির পর হিন্দুস্তান সোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (HSRA) প্রায় সমস্ত মেম্বারকে হত্যা করে অ্যার্গ্যানাইজেশনকে গোড়া থেকে নির্মুল করে দিয়েছিল ইংরেজ সরকার। উধম সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও হিংসাত্মক ঘটনা প্রত্যক্ষ প্রমাণ না থাকায় ৪ বছরের জেল পর্যন্ত তাঁর শাস্তি সীমিত ছিল। জেল থেকে বেরনোর পর আফগানিস্তান হয়ে পশ্চিমে মিলিয়ে যান উধম।
বহু দিন পর্যন্ত তাঁর নামে লুকআউট নোটিশ জারি ছিল। রাশিয়া, স্পেন, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড-সহ ইউরোপের বহু দেশ ঘুরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে চুপচাপ দেশের স্বাধীনতার জন্য সমর্থন এবং অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করার কাজ করে গিয়েছেন উধম। বলাই বাহুল্য যে, এ সব কাজ ঢাকঢোল পিটিয়ে করা যায় না। বিশেষত সেই সময়, যখন ইংল্যান্ডের সূর্য কখনও অস্ত যায় না। বার বার ইংল্যান্ডে এসেছএন বিভিন্ন পরিচয় নিয়ে। কাঠের মিস্ত্রি থেকে জুতো পালিশ, ওয়েল্ডার, সিনেমায় এক্সট্রার অভিনয়, মহিলাদের অন্তর্বাস বিক্রেতা কী করেননি তিনি। শুধুমাত্র স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং তৎকালীন MI5-এর নজর এড়ানোর জন্য। সফলও হয়েছিলেন।
এখানে আরও একটি বিষয় সম্পর্কে অনেকে জানতে পেরেছেন। অনেকেই জানতেন রেজিনাল্ড ডায়ার, যিনি জালিয়াঁওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিলেন, তাঁকে উধম সিং খুন করেছিলেন। আসলে তৎকালীন পঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল ও ডয়ার-কে হত্যা করেন উধম। কেন করেছিলেন, কী ভাবে তার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল, সেটা বলে এখানে স্পয়লার দেওয়া ঠিক হবে না। সব কিছুর জন্য সিনেমাটি একবার দেখতে হবে।
এ বার আসা যাক অভিনয়, স্ক্রিপ্ট এবং পরিচালনার প্রসঙ্গে। একবাক্য স্বীকার করতে হবে এটি ভিকি কৌশলের (Vicky Kaushal) এত দিনকার শ্রেষ্ঠ অভিনয়। ইরফানের জায়গায় তিনি যে চরিত্রের প্রতি পূর্ণ সুবিচার করেছেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সংলাপ না বলেও যে অভিনয় করা যায় তা বলিউডের গুটিকতক অভিনেতার মতো দেখিয়েছেন ভিকি। এই শিল্পে পারদর্শী খুব বেশি অভিনেতা বলিউডে নেই। এই সিনেমা করার আগে ২১ বছরের রিসার্চ এবং পরিশ্রম নিয়ে ইন্ডিয়া টুডে কনক্লেভে (India Today Conclave) যা বলেছিলেন পরিচালক সুজিত সরকার (Shoojit Sircar) তা এক বাক্য মেনে নিতে হবে। কারণ উধম সিং সম্পর্কে কোথাও বিরাট কোনও তথ্যের ভাণ্ডার নেই। ইংল্যান্ডে এখনও উধম সিং সম্পর্কে বেশ কিছু ফাইল ক্লাসিফায়েড। খুব কম তথ্য জানা যায় তাঁর সম্পর্কে। ফলে কাজটি কষ্টকর ছিল।
এ বার আসা যাক সিনেমার একটি বড় অংশ প্রসঙ্গে। জালিয়াঁওয়ালা হত্যাকাণ্ড এই সিনেমার অন্যতম চরিত্র। এর আগে অনেক সিনেমায় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেক কিছু দেখানো হয়েছে। কিন্তু এমন ডিটেলিং, হত্যাকাণ্ডের পর কী হয়েছিল, মৃত-আহতদের কী ভাবে সেখান থেকে বার করা হয়েছিল, তাঁদের চিকিৎসা, সে সময়কার কারফিউ, মার্শাল আইন এবং সেখানে উধম সিংয়ের ভূমিকা নিয়ে এর আগে কোনও সিনেমায় কিচ্ছু দেখানো হয়নি। একজন ২০ বছরের অনাথ যুবকের একমাত্র সম্পর্ক ওই মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস নিয়েছিল। সেখান থেকেই এই হত্যার বীজ চারাগাছ হয়ে ওঠে। অন্তত এই সিনেমার মাধ্যমে ওটিটি প্ল্যাফর্মে গোটা বিশ্ব সে ১৯১৯ সালের সেই বীভৎস নারকীয় দিন সম্পর্কে জানতে পারবেন।
যদি এক কথায় কেউ এই সিনেমা সম্পর্কে কিছু বলতে বলেন, তা হলে বলা যায় মাস্ট ওয়াচ। এখানে একটা স্পলায় না দিলেই নয়। উধম সিং নিজেকে রাম মহম্মদ সিং আজাদ হিসাবে ইংল্যান্ডের কোর্টে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু সে নাম কোর্ট প্রসিডিংসে লেখা হয়নি। নামটি প্রতীকী ছিল তা শুনেই বোঝা যায়। কিন্তু ইংল্যান্ড বুঝে গিয়েছিল, উপমহাদেশে উপস্থিত না থেকেও যদি পূর্ণ মাত্রায় উপস্থিত থাকতে হয় তবে ওই নামের মিথ ভেঙে দিতে হবে। সেটা তারা ভেঙে দিয়ে গিয়েছিল। তার ফল আজও ভোগ করতে হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশকে। এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ, বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হিংসা এবং ধর্মীয় বিবাদ।
অত্যন্ত সুখের বিষয়, ধর্মের নগ্ন রূপ নিয়ে এই সিনেমাটি ভাবতে বাধ্য করে।