"যে বাঁজা, সে রাজা
যে বাপ, সে রাজার বাপ।
কালের কোলে কপাল ফেরে
কেউ রাজা, কেউ রাজার বাপ।"
এই মুহূর্তে 'টক অফ দ্য টাউন' পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য (Anirban Bhattacharya)। সৌজন্যে, তাঁর ডিরেক্টোরিয়াল ডেবিউ ওয়েব সিরিজ (Web Series) 'মন্দার' (Mandaar)। শেক্সপিয়ারের (William Shakespeare) 'ম্যাকবেথ' (Macbeth), সর্বকালের সেরা ট্র্যাজেডিগুলির (Tragedy) মধ্যে একটি। আর সেটাই নিজের পরিচালনায় হাতেখড়ির বিষয় হিসাবে বেছে নিয়েছেন অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। 'ম্যাকবেথ'-র রূপান্তর 'মন্দার'-র ট্রেলার প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই প্রত্যাশা বেড়েছিল দর্শকদের।
গেইলপুরের নোনা সাগরের ধারে গড়ে ওঠা এক মৎসজীবী নগরী। এখানকার 'রাজ পরিবার', এক মৎসজীবী পরিবার এবং রাজা 'ডাবলু ভাই। 'কালের কোলে কপাল ফেরে। কেউ রাজা, কেউ রাজার বাপ।" এটা শুনেই মনে প্রশ্ন জাগে, কে রাজা আর কে রাজার বাপ? আসলে সেই জটিল উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। কারণ, কালের নিয়মে কার মাথায় কখন রাজমুকুট ওঠে...সে উত্তর বোধ হয় গেইলপুরের তিনজনের কাছেই শুধু আছে।
কার মাথায় উঠবে গেইলপুরের রাজমুকুট, মূলত সেই ক্ষমতা দখলের লড়াই তৈরি করে দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব, হিংসা, লোভ, বেইমানি, খুন ও তার প্রতিশোধের মতো পরিস্থিতিগুলি। গেইলপুরে কখন কার হয় চেকমেট, আর কার পাল্টে যায় নিয়তি, সেই ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে মজনু বুড়ি, তার ন্যাড়া ছেলে এবং তাদের পোষা কালো বিড়াল। যারা এই গল্পে 'ম্যাকবেথ' -র তিন ডাইনীকে প্রতিনিধিত্ব করে। অন্ধকারাচ্ছন্ন ফ্রেমে তাদের হঠাৎ উপস্থিতি এবং চোখ-মুখের কায়দা, এক অজানা গা ছমছমে ভাব তৈরি করতে সক্ষম সিরিজে।
ডাবলু ভাইয়ের দুই হাত মন্দার ও বঙ্কা। ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে কেউ কারওকে ছাড় দেয় না। যৌন সমস্যা থাকলেও স্ত্রী লাইলির প্রতি মন্দারের ভালোবাসায় কোনও কমতি নেই। বারবার খোঁটা খাওয়ার পর লাইলির কথাতেই ডাবলু ভাইকে খুন করে, কিংবা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খায় নপুংসক মন্দার। এদিকে ক্ষমতার লোভে লাইলি অন্য কারও শয্যাসঙ্গীনী হলেও, তা মেনে নেয় সে। সত্যি সম্পর্ক বড়ই জটিল! 'ক্ষমতা' নামক রাক্ষসের গ্রাসে গেইলপুরের এই খেলায় কখন খেলোয়াড়রাই একে অপরের ঘুঁটি হয়ে ওঠে, তা দর্শকরা ধীরে ধীরে ঠাওর করতে পারবেন।
ম্যাকব্যাথ ' -এ 'মোকাদ্দার মুখার্জী'-র চরিত্রের কোনও উল্লেখ না থাকলেও, নিজের গল্পে সেই অসৎ এবং সন্দেহজনক পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন খোদ পরিচালক। গোটা সিরিজ জুড়ে শুধু এই একটিমাত্র চরিত্রের ভাষা ভিন্ন। প্রথমে ইংরাজী দিয়ে শুরু করলেও, পড়ে সাবলীল শহুরে বাংলা ভাষায় কথা বলেন তিনি। অন্যদিকে গেইলপুরবাসীর মুখে শোনা যায়, 'খাই নিবি, 'রইলোনি কেনি'-র মতো আঞ্চলিক ভাষা। যা অনেকটাই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য।
'ম্যাকবেথ' যাঁদের পড়া নেই, সিরিজ দেখার আগে বিশেষ চিন্তায় পড়ার কোনও কারণ নেই। কারণ শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির পটভূমি অনুযায়ী এই গল্প এবং চরিত্রগুলির অনেকটা মিল থাকলেও, স্বতন্ত্র গল্প হিসাবেও এটাকে ভাবা যায়। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সেনসরশিপ না থাকার সুবাদে, সিরিজ জুড়ে রয়েছে গালাগালি, যৌনতা, নেশা, রক্ত, নেগিটিভিটি..। ফলে সিরিজ শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও তার রেশ মাথায় থেকে যেতে পারে। যারা 'মির্জাপুর' দেখেছেন, কয়েক মুহূর্তে সেখানকার ক্ষমতা দখলের লড়াই মনে পরতে পারে অনেকের।
থিয়েটারের জাত অভিনেতাদের অভিনয় দক্ষতা যেমন 'মন্দার'-কে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। তেমন কাজ করেছে আরও বেশ কয়েকটি ফ্যাক্টর। সৌমিক হালদারের ফ্রেমের উপযুক্ত সঙ্গত দিয়েছে আবহ সঙ্গীত। বলা বাহুল্য, দৃশ্যায়নের সঙ্গে রহস্য যেন আরও বাড়াচ্ছে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও দর্শকদের অন্য মনস্ক হতে দেয়নি সিরিজের টুকরো-টুকরো ঝলকগুলি। মনে দিয়ে দেখলে, নজর এড়াবে না সিরিজে প্রতীকী জিনিসের ব্যবহার। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, সিরিজটি যারা দেখবেন, হৃদস্পন্দন অনবরত বেড়ে-কমে যাবে।
সিরিজে মন্দারের (ম্যাকবেথ) ভূমিকায় অভিনয় করছেন থিয়েটার অভিনেতা দেবাশিস মণ্ডল এবং লাইলি (লেডি ম্যাকবেথ) চরিত্রে রয়েছেন সোহিনী সরকার। দেবেশ রায় চৌধুরী অভিনয় করছেন ডাবলু ভাই (কিং ডানকান), মুকাদ্দার মুখার্জির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শঙ্কর দেবনাথ, বঙ্কা (ব্যাঙ্কো) চরিত্রে, লোকনাথ দে, মদন (ম্যাকডাফ) চরিত্রে, দিগন্ত, মনচা (ম্যালকম) চরিত্রে এবং কোরক সামন্ত, ফন্টাস (ফ্লাইন্স) চরিত্রে অভিনয় করছেন। এছাড়াও 'ম্যাকবেথ' -র তিন ডাইনি রয়েছেন এখানে।সজল মণ্ডল অভিনয় করেছেন মজনু বুড়ির চরিত্রে এবং সুদীপ ধারাকে দেখা গেছে পেদোর ভূমিকায়। অন্যদিকে তৃতীয় জন কালা নামের একটি বিড়ালকে রূপায়িত করা হয়েছে।
দেবাশিস মণ্ডল যে লম্বা রেসের ঘোড়া তা এই সিরিজে প্রমাণ করেছেন। সোহিনী, তাঁর এতদিনের করা বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে সেরাটা দিয়েছেন। প্রতিটি চরিত্র নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল। নম্বর কাটার বিশেষ জায়গা নেই। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখেন সজল মণ্ডল এবং সুদীপ ধারা। তবে হ্যাঁ শুধু অভিনয়, চিত্রগ্রহণ, আবহসঙ্গীতের কথা বললে ভুল হবে। আরও একটি দিক এই সিরিজ এগিয়ে নিয়ে যেতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা হল সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপ।
গোটা সিরিজটি দেখার পর নচিকেতার কণ্ঠে, "রাজার মুকুট রাজার সাজ অন্য কেউ তা পরবে আজ..." এই জনপ্রিয় গানটি মনে পড়তে পারে অনেকের। কাল্পনিক গল্পে 'ক্ষমতার লোভ' নামক রাক্ষস যে সবটা খেয়ে নিতে পারে, তা বাস্তব জীবনেও যে সম্ভব, শুধুমাত্র আলাদা প্রেক্ষাপটে, সেই প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন পরিচালক।