Advertisement

'মুম্বইয়ের বাঙালিটোলার' প্রিয় বোন ছিলেন লতা, রাখি বাঁধতেন হেমন্ত-কিশোরকে

বাঙালি প্রযোজক-পরিচালক থেকে সঙ্গীত পরিচালক-গায়ক-গায়িকা, এক সময়কার বোম্বাই সিনেমাজগতে বাঙালিদের দাপট ছিল নজরে পরার মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সলিল চৌধুরী, কিশোর কুমার থেকে মান্না দে, আবার পরিচালকদের মধ্যে বাসু চট্টোপাধ্যায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় সকলেই বাংলায় কথা বলতেন লতার সঙ্গে। ঘরের মেয়ের মতোই দেখতেন জোড়া বিনুনি করে গাইতে আসা সাদামাটা অথচ অসম্ভব প্রতিভাময়ী গায়িকাকে।

হেমন্ত - লতা - কিশোর
রজত কর্মকার
  • কলকাতা,
  • 06 Feb 2022,
  • अपडेटेड 10:17 AM IST
  • নিজের বৃহৎ পরিবারের পাশে এই বাঙালি টোলার বিশেষ প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন লতা।
  • এক সঙ্গে কয়েক জনের বোনও হয়েছিলেন।
  • যাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কিশোরকুমার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

আশঙ্কা সত্যি করেই রোব্বারের সকালটা তেঁতো করে দিয়ে চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর (lata mangeshkar death news)। আচমকাই যেন সলিল চৌধুরীর (Salil Chowdhury) সুরে লতার গাওয়া গানটি মনে পড়ে গেল। 'বড় শূন্য শূন্য দিন...'। সত্যিই বড় শূন্যই করে দিয়ে গেলেন ভারতের নাইটিঙ্গেল।

হিন্দি ছাড়াও দেশের বহু ভাষায় অসংখ্য স্মরণীয় গান গেয়েছেন লতা। আর বাংলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অতি বিশেষ। শিল্পী-গায়ক-গায়িকা সকলের সঙ্গে সখ্য ছিল সুর সম্রাজ্ঞীর। তার কারণও ছিল অবশ্য।

বাঙালি প্রযোজক-পরিচালক থেকে সঙ্গীত পরিচালক-গায়ক-গায়িকা, এক সময়কার বোম্বাই সিনেমাজগতে বাঙালিদের দাপট ছিল নজরে পরার মতো। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (Hemanta Mukhopadhyay) থেকে সলিল চৌধুরী, কিশোর কুমার (Kishore Kumar) থেকে মান্না দে (Manna De), আবার পরিচালকদের মধ্যে বাসু চট্টোপাধ্যায়, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় সকলেই বাংলায় কথা বলতেন লতার সঙ্গে। ঘরের মেয়ের মতোই দেখতেন জোড়া বিনুনি করে গাইতে আসা সাদামাটা অথচ অসম্ভব প্রতিভাময়ী গায়িকাকে। জীবনে বহুবার এ কথা জানিয়েছেন খোদ লতা। সেই শিল্পীদের প্রতি তাঁর দারুণ শ্রদ্ধা ছিল।

নাসরিন মুন্সি কবীর-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যা পরবর্তীকালে 'আপনে খুদ কি শব্দো মে লতা মঙ্গেশকর' নামে বই আকারে প্রকাশিত হয়, লতা বলেন, 'আমি তখন খেদচন্দ প্রকাশের সঙ্গে কাজ করছি। তখন গ্রান্ট রোড থেকে মালাড পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করতাম। সেখান থেকে রেকর্ডিং স্টুডিও পর্যন্ত হেঁটে বা টাঙায় যেতাম। একদিন রেকর্ডিং ছিল। মহালক্ষ্মী স্টেশন থেকে এক যুবক আমার কামরাতেই উঠলেন। কুর্তা-পাজামার সঙ্গে গলায় স্কার্ফ পরে তিনি বসেছিলেন। হাতে একটা ছড়ি ছিল। অদ্ভূত ভঙ্গি দেখে আমি খানিক ভয়ই পেয়েছিলাম। পরে দেখেলাম তিনি টাঙায় করে আমার পিছনেই আসছেন। তখন ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম। কোনও ক্রমে দ্রুত রেকর্ডিং স্টুডিওতে পৌঁছলাম। দেখলাম সেই যুবকও স্টুডিওতে ঢুকলেন। সেখানে খেমচন্দ জি বসেছিলেন। তাঁকে দেখেই বললাম, আঙ্কল এই লোকটা আমায় ফলো করছে। খেমচন্দ জি তখন হেসে বললেন, আরে এ তো কিশোর। অকোশ কুমারের ভাই। আজ তোমার সঙ্গে ডুয়েট গাইবে। মানুষকে হাসানো এবং মজা করার স্বভাব কিশোরদার চিরকালীন। প্রসঙ্গত, জিদ্দি ছবির গান ইয়ে কৌন আয়া করকে সোলহা সিঙ্গার আমাদের প্রথম ডুয়েট গান। প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে কিশোরদার-ও প্রথম ছবি ছিল জিদ্দি।'

Advertisement

সেই সখ্য আত্মীয়তা পর্যন্ত গড়িয়েছিল। নিজের বৃহৎ পরিবারের পাশে এই বাঙালি টোলার বিশেষ প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠেছিলেন লতা। এক সঙ্গে কয়েক জনের বোনও হয়েছিলেন। যাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য কিশোরকুমার এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে লতা বলেছিলেন, 'গায়কদের কী অসম্ভব কোয়ালিটি ছিল সে সময়! কিশোরদার কথা ভাবুন। জীবনে কখনও রেওয়াজ করেনি। অথচ কী গলা! যখন ডুয়েট গাইতাম এক এক সময় স্তম্ভিত হয়ে ভাবতাম, আহা, একেই বুঝি গান বলে! হেমন্তদা তো দরজা থেকেই চিৎকার করতে করতে ঢুকতেন এই লতা, লতা। হেমন্তদার শেষজীবনটাও ভাল কাটেনি শুনে আজও আমার খারাপ লাগে। কিশোরদাকে ভুলতে পারি না। প্রচণ্ড হাসাতেন। হৃষিদা মজা করতেন। সব বাংলায়। আমি যে ওখানে আছি অন্য ভাষার একটা লোক, সে সব কেউ পাত্তাও দিত না। হেমন্তদা আর কিশোরদা— দু’জনে ই ছিলেন আমার রাখিভাইয়া।'

আগেও সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, বাংলা ছবি দেখতে খুব ভালোবাসতেন লতা। উত্তম কুমারের ক্যারিশমা তাঁখে স্পর্শ করেছিল। খুব প্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন সুচিত্রা সেন। আঁধি ছবির গান গাওয়ার সময় সুচিত্রার সঙ্গে সামনাসামনি সাক্ষাৎ হয়েছিল লতার। লতা জানিয়েছিলেন তিনি সুচিত্রার অভিনয়ের ফ্যান। একই ভাবে সুচিত্রা জানিয়েছিলেন, তিনিও লতার গায়কীর অসম্ভব ফ্যান। স্টুডিওতে এসেছেন তাঁর গান শোনার জন্য এবং আলাপ করার জন্য। তার পর দীর্ঘ ক্ষণ আড্ডা জমে উঠেছিল তাঁদের।

আর গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর রীতিমতো বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। তা-ও জানিয়েছিলেন লতা। তিনি বলেন, 'সন্ধ্যা তো আমার সহেলি। কী সব গান গেয়েছে! আমরা হিন্দিতে ডুয়েটও গেয়েছি। কলকাতায় গেলে আমি ওর বাড়িতে গিয়েছি। সন্ধ্যা মুম্বই এলে, ওর হোটেলে গিয়েছি আড্ডা মারতে।' একই ভাবে তাঁর 'সহেলী' গীতা দত্তের প্রয়াণেও ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন। প্রতি বছর নিয়ম করে গীতার প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলী জানাতেন।

এ বার সেই প্রথায় ছেদ পড়তে চলেছে। চিরকালের জন্য।


কৃতজ্ঞতা:

আনন্দবাজার পত্রিকা

আনন্দধারা (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী)

অপনে খুদ কি শব্দো মে লতা মঙ্গেশকর, নাসরিন মুন্সি কবীর (নিয়োগী বুকস)

 

Read more!
Advertisement

RECOMMENDED

Advertisement