এমনভাবে নিজের স্বামীকে মারতে চেয়েছিলেন যেন খুন বলে মনে না হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে স্বামীর, এমনটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন স্ত্রী। উদ্দেশ্যে তিনি সাময়িকভাবে সফলও হন। কিন্তু পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে সত্যিটা। বিয়ের পর অশান্তি, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক, প্রেমিকের সঙ্গে যোজসাজশ, তারপর স্বামীকে খুন। তাও একদিনে নয়। ধীরে ধীরে। কয়েক মাস ধরে। এই হত্যাকাণ্ডের জট খুলেছে পুলিশ। যা সিনেমার স্ক্রিপ্টকেও হার মানাবে।
মৃত সেই ব্যক্তির নাম কমলকান্ত শাহ। একদিন হঠাৎ পেটে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান তিনি। হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়। কিন্তু, ভর্তি হওয়ার পরও শেষরক্ষা হয়নি। একে একে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে শুরু করে। তারপর মারা যান। মুম্বইয়ের ওই পোশাক ব্যবসায়ীর মৃত্যুর জন্য দায়ি তাঁর স্ত্রী। তাঁর নাম কাজল। তিনি ৭ মাস ধরে পরিকল্পনা করেন। স্বামীর খাবারে ২ মাস ধরে বিষ দিয়ে তাঁকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন।
২৪ অগাস্ট ২০২২
পোশাক ব্যবসায়ী কমলকান্ত শা সেদিন পেটে তীব্র ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসার পর ওষুধ দেন। কিন্তু ব্যথা কমেনি। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২-এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। সেদিনই মারা যান তিনি।
কমলকান্তের মেডিকেল রিপোর্ট
ডাক্তাররা কমলাকান্তের মৃত্যুর আগে থেকেই তাঁর অসুস্থতার কারণ বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। মৃত্যুর পর কমলাকান্তের রক্তের রিপোর্ট ডাক্তারদের হাতে আসে। আর তা দেখে অবাক হয়ে যান তাঁরা। দেখা যায়, কমলাকান্তর রক্তে ধাতুর পরিমাণ অনেক বেশি। স্বাভাবিকের থেকেও একশগুণ। রক্তে বিশেষ করে ২ রকম ধাতুর পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, কোনও মানুষের শরীর এর প্রভাবে গলেও যেতে পারে।
স্বাভাবিক মৃত্য নয়, বুঝতে পারেন ডাক্তাররা
ডাক্তাররা দেখেন, কমলাকান্তের রক্তে আর্সেনিকের পরিমাণ ছিল ৪০০ গুণ বেশি। থ্যালিয়ামের পরিমাণ ছিল ৩৬৫ গুণ বেশি। ডাক্তাররা বুঝতে পারেন, কোনওভাবেই একজন মানুষের শরীরে এত বেশি পরিমাণ এমন ধাতু পাওয়া সম্ভব নয়। এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
পুলিশ মরদেহ পোস্টমর্টেম করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কমলাকান্তের মায়ের মৃত্যু নিয়েও প্রশ্ন
এই ঘটনার পরই কমলাকান্তের মায়ের মৃত্যুর কারণ নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। ওই পোশাক ব্যবসায়ীর মা সরলা দেবী ১৩ অগাস্ট ২০২২-এ কোকিলাবেন হাসপাতালে মারা যান। তাঁরও অঙ্গ বিকল হয়েছিল। তদন্তকারীদের মনে প্রশ্ন আসে, এই দুইজনের মৃত্যু পরস্পরের সঙ্গে সর্ম্পর্কিত কিনা।
আসরে কমলাকান্তের বোন
ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমেই কমলাকান্তের পরিবারের সদস্যজের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কমলাকান্তের স্ত্রী কাজলসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আর তখনই মৃত কমলাকান্তের বোন কবিতা পুলিশকে চমকপ্রদ তথ্য দেয়। কবিতা জানান,কমলাকান্ত হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সময় তাঁর শ্যালিকা টাকা ও অ্যাকাউন্টের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। কমলাকান্ত মারা যাওয়ার পর তিনি আরও নানা খোঁজ নিতে শুরু করেন।
চিকিৎসকরা জানান, কমলাকান্তের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী কাজলের আচরণে কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। তিনি কষ্ট পেয়েছেন বলেও মনে হয়নি।
ডাক্তারদের বয়ান
ডাক্তাররা জানান, কমলাকান্তের রক্তে যে আর্সেনিক ও থ্যালিয়াম মিলেছে তা আসলে ধীরগতির বিষ। এই বিষ খাবারে মেশালে স্বাদ বা রঙের কোনও পরিবর্তন হয় না। তবে শরীরের ভিতরে ভিতরে ক্ষতি করে। এখন প্রশ্ন হল, সবাই যদি একসঙ্গেই খেতে বসত, তাহলে শুধু কমলাকান্তের শরীরেই এত বেশি পরিমাণে সেই বিষ এল কীভাবে?
সামনে এল হিতেশ জৈনর নাম
ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশের সন্দেহ ঘনীভূত হয় কমলাকান্তের স্ত্রী কাজলের উপর। তদন্তকারীরা কাজলের সিডিআর অর্থাৎ কল ডিটেইল রেকর্ড বের করে। সেখানে দেখা যায়, হিতেশ জৈন নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে কাজল নিয়মিত কথা বলত। আর দীর্ঘক্ষণ। এবার হিতেশের খোঁজ করতে শুরু করল পুলিশ।
হিতেশের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কাজল
কল রেকর্ড হাতে আসার পর পুলিশ ফের কাজলের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। কাজল জানান, তাঁর সঙ্গে হিতেশের প্রেমের সম্পর্ক আছে। হিতেশের সঙ্গে মিলে কমকান্তকে খুনের পরিকল্পনা করেন তিনি। যাতে হিতেশের সঙ্গে সুখে থাকতে পারেন। কাজল এও জানান যে, হিতেশই তাঁকে বলে দিয়েছিল, খুন কীভাবে করতে হবে।
কমল ও হিতেশের সম্পর্ক
আসলে কমলাকান্ত ও হিতেশ দুজনে ছোটোবেলার বন্ধু। বিয়ের প্রায় দশ বছর পর কমলকান্তের বন্ধু হিতেশকে প্রথম দেখেন কাজল। তখন কমলাকান্তের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না কাজলের। কমলাকান্ত স্ত্রীর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছিল। সেই সুযোগে হিতেশ কাজলের জীবনে চলে আসে।
৭ মাসের ষড়যন্ত্র
মাঝে সন্তানদের নিয়ে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাবার বাড়ি গিয়েছিলেন কাজল। তবে পরিকল্পনার অংশ হিসেসে ১৫ জুন শ্বশুরবাড়ি ফিরে আসেন। তারপর থেকে স্বামী ও শাশুড়ির খাবারে বিষ দিতে শুরু করেন। এভাবে বিষ দিতে থাকার পর প্রায় সাতমাস পর কমলাকান্ত মারা যান।
অপহরণের গল্প ফাঁদে হিতেশ
ঘটনা সামনে আসার পরই পুলিশ কাজলকে গ্রেফতার করে। তবে গ্রেফতারের ভয়ে কাজলের প্রেমিক হিতেশ অপহৃত হওয়ার কাহিনি শোনান তদন্তকারীদের। তিনি জানান, কয়েকজন তাঁকে অপহরণ করে বেধড়ক মারধরের পর শাহপুরের নাসিক সড়কে ফেলে দেয়। পুলিশ তাঁকে যখন আটক করে তখন তাঁর শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
তবে পুলিশ হিতেশকে বিশ্বাস করেনি। তদন্তকারীরা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকেন। হিতেশ স্বীকার করে নেন, গ্রেফতারি এড়াতেই তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কেউ তাঁকে অপহরণ করেনি।
তিনি নিজেই নিজেকে আঘাত করে পুলিশকে মিথ্যে বলেছিলেন।
আর্সেনিক ও থ্যালিয়াম কি, কীভাবে এই ধাতুগুলি মানুষের প্রাণ নেয়
বিশেষজ্ঞদের মতে, আর্সেনিক মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে দুর্বল করে দেয়। খাবার হতে দেয় না। এতে শরীরের অনেক অংশ কাজ করা বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে, থ্যালিয়ামও জলে দ্রবণীয় রাসায়নিক। ইতিহাস সাক্ষী, অনেক শাসককে এই রাসায়নিক দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
চিকিৎসকদের মতে, এই দুই ধাতু শরীরে প্রবেশ করলে তা অবিলম্বে জানা যায় না। প্রথম দিকে বমি, পেটব্যথা ও মাথাব্যথা হয়। এরপর শরীরের অঙ্গগুলি কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আর্সেনিক এবং থ্যালিয়াম কাওকে নিয়মিত খাওয়ানো হলে তিনি ১৫ থেকে ২৫ দিনের মধ্যে মারা যেতে পারেন।