গ্যাংস্টার দাউদ ইব্রাহিম (Dawood Ibrahim)। ভারতের অন্যতম শত্রু। তাকে করাচির এক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে বলে খবর। দাবি করা হচ্ছে, দাউদকে বিষ খাওয়ানো হয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে পাকিস্তানে লুকিয়ে রয়েছে সে। করাচিতে বসে সারা বিশ্বে অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছে। এমনকী ভারতীয় এজেন্সি দাউদের ফোন কলের বিবরণও বের করেছে।
ভারতের মোস্ট ওয়ান্টেড দাউদ ইব্রাহিম ১৯৯৩ সালের মুম্বই বোমা হামলার প্রধান অভিযুক্ত। আমেরিকাও তাকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করেছে। মুম্বই বিস্ফোরণের পর দাউদ ভারত থেকে পালিয়ে যায়। ডি কোম্পানির মালিক দাউদের গতিবিধি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই নজর রাখছে ভারত। এমনকী গোয়েন্দা সংস্থাগুলি দাউদের খোঁজে পাকিস্তানেও গিয়েছিল। কিছুদিন আগে, নানা তথ্য প্রমাণ হাতে পাওয়ার পর ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে, দাউদ করাচিতে রয়েছে এবং সেখান থেকে তার অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছে।
করাচির ক্লিফটন রোডে দাউদের বাড়ি। নাম হোয়াইট হাউস। সেখানেই সপরিবারে থাকেন দাউদ। এছাড়াও করাচির ডিফেন্স হাউজিং কলোনিতে রয়েছে ৩৭ নম্বর বাংলো। দাউদের দ্বিতীয় আস্তানা। সদ্য প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দাউদ ইব্রাহিম এখন করাচির ডিফেন্স এলাকায় আবদুল্লাহ গাজি বাবা দরগার পিছনে রহিম ফাকিরের সঙ্গে থাকেন। যে রাস্তায় তার বাংলো অবস্থিত সেটি করাচির একটি নো-ট্রেপাস জোন। পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ওই এলাকা পাহারা দেয়। দাউদকে ISI সুরক্ষা দেয়। ভারত সরকার জানিয়েছে, দাউদ সংক্রান্ত সব প্রমাণ পাকিস্তানকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেই প্রমাণগুলোকে অস্বীকার করে আসছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে দাউদ পাকিস্তানে নেই। যদিও পরে পাকিস্তান স্বীকার করে যে, দাউদ সেই দেশেই আছে।
দাউদের পরিবার ও দুবাই
কাজকর্ম-ব্যবসার সূত্রে দাউদ গোটা বিশ্বে ঘুরে বেড়ায়। তার ১৪টি পাসপোর্ট রয়েছে। মাঝে মাঝে দুবাই যায় তার স্ত্রী এবং চার সন্তানের সঙ্গে। নথি থেকে এটি পরিষ্কার যে দাউদ তার স্ত্রী এবং চার সন্তানের সঙ্গে করাচিতে থাকে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি দাউদ ইব্রাহিমের স্ত্রী জুবিনা জারিন ওরফে মেহজাবিনের নামে একটি টেলিফোন বিল এবং দাউদের বেশ কয়েকটি পাসপোর্টও খুঁজে পেয়েছে। aajtak-এর কাছে দাউদের সংক্রান্ত ভারতের DOSSIER-এর একটি কপি রয়েছে। NSA পর্যায়ের আলোচনায় এই ডসিয়ার পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। দাউদের পাকিস্তানে থাকার ডসিয়ারে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এতে দাউদের ৯টি অবস্থানের উল্লেখ রয়েছে। এই সব জায়গা পাকিস্তানে অবস্থিত। তাও আবার করাচিতে। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদেও দাউদের আস্তানা রয়েছে।
দাউদের দ্বিতীয়বার বিয়ে
পাকিস্তানি পাঠান মেয়েকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন দাউদ ইব্রাহিম। দাউদের প্রথম স্ত্রী জুবিনা জারিন ওরফে মেহজাবীনও এই দাবির সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। দাউদের প্রথম স্ত্রী মেহজাবীন হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভারতে তার আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। মেহজাবীন মুম্বাইয়ের বাসিন্দা। তার সম্মতিতেই দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন দাউদ।
দাউদ ইব্রাহিম কে?
মোস্ট ওয়ান্টেড আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের জন্ম ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বরে মহারাষ্ট্রের রত্নাগিরি জেলায়। তার বাবা ইব্রাহিম কাসকর ছিলেন একজন পুলিশ কনস্টেবল। পরে দাউদ ইব্রাহিমের পরিবার মুম্বাইয়ের ডোংরি এলাকার বস্তিতে থাকতে শুরু করে। সাতের দশকে মুম্বই আন্ডারওয়ার্ল্ডে দাউদ পরিচিত নাম হতে শুরু করে। দাউদ আগে হাজি মস্তান গ্যাংয়ে কাজ করত। সেখানে থাকতে থাকতেই তার প্রভাব বাড়তে থাকে। নয়ের দশকে মুম্বাইয়ে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল তার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল দাউদ। বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দাউদ ভারত ছেড়ে দুবাই পালিয়ে যায়। এরপর পাকিস্তানে ঘাঁটি তৈরি করে। সেই থেকে এখনও পরিবার নিয়ে সেখানেই থাকে দাউদ। তার বিরুদ্ধে ভারতে সন্ত্রাসবাদী হামলা, হত্যা, অপহরণ, চুক্তি হত্যা, সংগঠিত অপরাধ, মাদক, অস্ত্র চোরাচালানের মতো অনেক মামলা রয়েছে। ২০০৩ সালে, তাকে বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড ঘোষণা করা হয়। ২০১১ সালে এফবিআই এবং ফোর্বসের তালিকায় বিশ্বের তৃতীয় মোস্ট ওয়ান্টেড পলাতক অপরাধীর হিসেবে দাউদের নাম উঠে আসে।
দাউদ ও তার পরিবার
দাউদ ও মেহজাবিনের চার সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ে। মেয়েদের নাম মাহরুখ ইব্রাহিম, মাহরিন ইব্রাহিম, মারিয়া ইব্রাহিম। ছেলের নাম মইন ইব্রাহিম নওয়াজ। দাউদের বড় মেয়ে মাহরুখ ইব্রাহিম ২০১৪ সালে প্রাক্তন পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াঁদাদের ছেলে জুনায়েদের সঙ্গে বিয়ে করে। দাউদের দ্বিতীয় মেয়ে মাহরিনও পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান ব্যবসায়ী আইয়ুবের সঙ্গে চারহাত এক করে। ছোটো মেয়ে ১৯৯৮ সালে মারা যায়। ছেলে বিয়ে হয় সোনিয়া নাম এক জনের সঙ্গে।
দাউদের পাঁচ ভাই-বোন রয়েছে। তারা হল হাসিনা পারকার, সাঈদা পারকার, ফারজানা টুঙ্গেকার ও মমতাজ শেখ। দাউদের স্ত্রী মেহজাবিন দুই ভাই আনিস ইব্রাহিম এবং নুরা ইব্রাহিম। মুম্বই বিস্ফোরণের পর দাউদের সঙ্গে দুবাই পালায়। তবে ২০০৭ সালে করাচি বোমা বিস্ফোরণে নুরা মারা যায়। দ্বিতীয় ভাই আনিস দাউদের সঙ্গে থাকে। তৃতীয় ভাই ইকবাল পরিবারের সঙ্গে মুম্বাইয়ে বসবাস করছে। দুই বোন হাসিনা পারকার ও সাঈদা মুম্বইয়ে থাকত। তবে এখন দুজনেই মারা গেছে।
দাউদের ১৫টি ডাকনাম...
১৯৯৩ সালে মুম্বই বোমা বিস্ফোরণ ছাড়াও, দাউদ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ২৬/১১ সন্ত্রাসবাদী হামলা,নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদার ওসামা বিন লাদেন এবং আয়মান আল-জাওয়াহিরিকে সাহায্য, 2G স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি এবং আইপিএল স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ রয়েছে।
রাষ্ট্রসংঘ দাউদের একাধিক নাম খুঁজে পেয়েছে। দাউদ ইব্রাহিম, শেখ দাউদ হাসান, আবদুল হামিদ আবদুল আজিজ, আনিস ইব্রাহিম, আজিজ দিলীপ, দাউদ হাসান শেখ ইব্রাহিম কাসকর, দাউদ ইব্রাহিম মেমন কাসকর, দাউদ হাসান ইব্রাহিম কাসকর, দাউদ হাসান ইব্রাহিম মেমন, দাউদ সাবরি, কাসকার দাউদ হাসান, শেখ মোহাম্মদ ইসমাইল আবদুল রহমান, দাউদ হাসান শায়খ ইব্রাহিম, শেখ ইসমাইল আবদুল ও হিজরত। - এস. হুসেন জাইদির বই 'ডংরি সে দুবাই তাক'-এও দাউদের বিভিন্ন নাম রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
প্রথমদিকে দাউদ'মুসাদ' নামে পরিচিত ছিল। সেই সময় সে মোটা ও ঘন গোঁফ রাখত। সেজন্য তাকে এই নামে ডাকা হত। কিন্তু ভারত থেকে পালানোর পর মুসাদ হয়ে ওঠে দাউদ। শোনা যায়, দাউদ একাধিকবার মুখের প্লাস্টিক সার্জারি করেছে। পাকিস্তানে এখন দাউদের নাম শেখ দাউদ হাসান।এ ছাড়াও কেউ কেউ তাকে ডেভিড বা ভাই বলেও ডাকে।
ভারত সরকার পাকিস্তানের কাছে দাউদ সংক্রান্ত যে তথ্য দিয়েছে সেখানে উল্লেখ, দাউদের ব্যবসা ইউরোপ, আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার এক ডজনেরও বেশি দেশে ছড়িয়ে আছে। শুধুমাত্র ব্রিটেনেই তার ৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সম্পদ রয়েছে। দাউদ বিভিন্ন দেশে ৫০টির বেশিও কোম্পানিতে টাকা বিনিয়োগ করেছে। দাউদের ব্যবসা ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন, জার্মানি, তুরস্ক, ফ্রান্স, স্পেন, মরক্কো, সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত।
নানা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, দাউদ যা আয় করে তার ৪০ শতাংশ ভারত থেকে পায়। ভারতে তার প্রধান ব্যবসা হল ফেক ইন্ডিয়ান কারেন্সি নোট। তবে মোদী সরকারের নোটবন্দির কারণে দাউদের ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় দাউদের হীরের অবৈধ ব্যবসা রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় খনন করা বেশিরভাগ হীরা ভারতে আসে কাটিং এবং পালিশের জন্য। ফোর্বস ২০১৫ সালে জানায়, দাউদের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৬.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।