কোভিডের পর থেকে গোয়ায় কমছে পর্যটকের সংখ্যা। আর তাতে সামগ্রিকভাবে সমস্যায় পড়ছে রাজ্যের অর্থনীতি। কারণ এই রাজ্যের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তিই হল পর্যটন। গোয়া বিদেশি পর্যটকদের ওপরে বিশাল পরিমাণে নির্ভরশীল। কিন্তু আদতে দেখা যাচ্ছে, গোয়াতে কমছে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা। পরিবহন, নিরাপত্তা, পরিষেবার খরচ এবং পরিকাঠামোগত সমস্যা থেকে শুরু করে ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, পর্যটকর কমার কারণ হিসেবে এগুলোই উঠে আসছে।
২০১৯ সালে গোয়ায় প্রায় ৯.৪ লক্ষ বিদেশি পর্যটক এসেছিলেন। কিন্তু ২০২৩ সালে মাত্র ৪.০৩ লক্ষে নেমে আসে। তার মানে কয়েক বছরে বিদেশি পর্যটকের পরিমাণ কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। বিশেষ করে ২০২২ সালে ২০১৮ সালের তুলনায় বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা ৮২ শতাংশ কমেছে।
ট্যাক্সি মাফিয়া
'ট্যাক্সি মাফিয়াদের' আধিপত্যের কারণে গোয়ার পর্যটন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলি বেশিরভাগ ট্যাক্সি পরিষেবা নিয়ন্ত্রণ করে এবং পর্যটক এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের শোষণ করার অভিযোগ রয়েছে। বেশি ভাড়া, মিটারে না যেতে চাওয়া, সকারি নির্দেশ না মানা, এসব এদের কাছে জলভাত। আর এতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন বিদেশি পর্যটকরা। অভিযোগ, বেশি ভাড়া নিয়ে আপত্তি জানালে ভয় দেখানো হয় বা ট্যাক্সি ড্রাইভাররা যেতে চায় না।
Ola এবং Uber এর মতো অনলাইন ট্যাক্সি পরিষেবার অভাব পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। পর্যটকদের স্থানীয় ট্যাক্সির ওপর নির্ভর করতে হয়, যেখানে বেশি ভাড়া নেওয়া স্বাভাবিক ঘটনা। ট্যাক্সি মাফিয়ার নিয়ন্ত্রণ গোয়ার সামগ্রিক পর্যটনের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। পর্যটকদের যাওয়া-আসার জন্য এই অপারেটরদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হতে হয়। কারণ সরকারি বাসের সংখ্যাও হাতেগোনা এখানে। গাড়ি ভাড়া করতেও এখানে মোটা টাকা গুনতে হয়। ট্যাক্সি মাফিয়াদের বাড়বাড়ন্তের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে ও পর্যটক-বান্ধব গন্তব্য হিসেবে গোয়ার খ্যাতি নষ্ট করেছে।
স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন যে গোয়ার খ্যাতি ফেরানোর জন্য ট্যাক্সি মাফিয়াদের এই সমস্যা সমাধান করা এবং অ্যাপ-ভিত্তিক ট্যাক্সি পরিষেবা চালু করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। না হলে বিদেশি পর্যটকদের আস্থা ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। কারণ এখন গোয়ার মতো আরও বিকল্প গন্তব্য রয়েছে সারা বিশ্বে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের দাবি, Ola এবং Uber-এর মতো পরিষেবা চালু করা হলে ভাড়া নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে। মাফিয়াদের ক্ষমতা কমতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজার পরিস্থিতির কারণে এই অঞ্চল থেকে পর্যটকদের সংখ্যা এমনিতেই কমে গিয়েছে। কোভিডের আগে রাশিয়া থেকে গোয়ায় প্রতিদিন পাঁচটি চার্টার ফ্লাইট আসত। দ্য গোয়ান এভরিডে রিপোর্ট করেছে, এখন প্রতি সপ্তাহে মাত্র কয়েকটি ফ্লাইট অবতরণ করে গোয়াতে। একইভাবে, গোয়া একসময় অসংখ্য ইজরায়েলি পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক আবহাওয়ার কারণে ইজরায়েল থেকে চার্টার ফ্লাইট আসা স্থগিত করা হয়েছে। ব্রিটেনের নাগরিকদের জন্য ভারতের ই-ভিসা বিলম্বের কারণেও পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। কমেছে ইউরোপীয় পর্যটকদের সংখ্যা। তবে, আশার আলো উজবেকিস্তান এবং কাজাখস্তান থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে।
অভ্যন্তরীণ পর্যটনের বৃদ্ধি
গোয়ার জন্য আরেকটি আশার আলো হল অভ্যন্তরীণ পর্যটনের বৃদ্ধি। যা বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা কমার কিছু ক্ষতি পূরণ করতে সাহায্য করেছে। ২০১৯ সালে গোয়াতে প্রায় ৮০.৬ মিলিয়ন দেশের অন্য রাজ্যের মানুষ বেড়াতে গিয়েছিলেন। ২০২০ সালে সংখ্যা কমলেও ২০২৩ সালে বেড়ে ৭৬.১ মিলিয়ন হয়। যাইহোক, অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আগমন সত্ত্বেও স্থানীয় অপারেটররা যুক্তি দেন যে বিদেশি পর্যটকদের আসাটা পর্যটন খাতের আর্থিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কী কী করতে হবে?
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছেন। শিল্প নেতারা ভিসা ফি এবং বিমানবন্দরে অবতরণ চার্জ কমানোর দাবি জানিয়েছেন। এছাড়াও ভিসা-অন-অ্যারাইভাল প্রক্রিয়া সহজ করার দাবিও রয়েছে। ব্যবসায়ীদের যুক্তি এই পদক্ষেপগুলি নিলে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো অন্যান্য ভ্রমণ গন্তব্যগুলির সঙ্গে গোয়া আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। সস্তায় বেড়ানোর অপশন পাবেন বিদেশি পর্যটকরা। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট পরিষেবার উনন্নতি, সমুদ্র সৈকত নানা সুবিধা এবং সামগ্রিক পর্যটন পরিকাঠামোর উন্নতি করার দাবিও রয়েছে ব্যবসায়ীদের।
নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত গোয়ায় পর্যটকের ঢল নামে। তাই গোয়া কতটা ভালভাবে ফিরে আসতে পারে তা নির্ধারণে এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ হবে। যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হয় এবং পদক্ষেপগুলি বাস্তবায়িত হয়, তবে এই রাজ্যটি এশিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটন গন্তব্য হিসাবে তার আগের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে পারে।