ছেলেবেলা থেকেই বাঙালি হিন্দু পরিবারে সেখানো হয়, 'এটা করতে নেই। ওটা পাপ। এটা অশুচি।' সেই তালিকায় সর্বপ্রথম আসে বিধবারা। কোনও শুভ কাজ তাদের দিয়ে করানো মানেই সেই কাজ পণ্ড হয়ে যাওয়া, এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ মা-ঠাকুমারা।
শারদোৎসব মানে একটু খোলা হাওয়া। রঙিন, মুক্তির স্বাদ পাওয়া বছরের চারটে দিন। নিয়মের বেড়াজাল পেরিয়ে আনন্দে গা ভাসানো। মা দুর্গার আরাধনায় আচার, রীতিনীতি মানলেও এই সময়টা হল ছক ভাঙার।
গত কয়েক বছর ধরেই দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিন ছক ভাঙা দৃশ্য দেখা যাচ্ছে এ শহরে। মায়ের বরণ করছেন বিধবা মহিলারাও। স্বামীর মৃত্যু হলেও সিঁদুর খেলেছেন তারা। শহরের একাধিক পুজোয় সে চিত্র দেখা গিয়েছে। তবে সকলেরই প্রশ্ন, আদৌ কি সিঁদুর খেলতে পারেন বিধবারা?
দুর্গাপূজার শেষ দিনে সিঁদুর খেলা চিরাচরিত নিয়ম। বিবাহিত মহিলারা দেবীর কপালে এবং পায়ে সিঁদুর লাগান এবং তারপর একে অপরের উপর সিঁদুর মাখান। দুর্গার প্রতিমা জলে নিমজ্জিত করার আগে এটিই শেষ উদযাপন।
সিঁদুর খেলায় সঠিক উৎপত্তি কোথায় তা স্পষ্ট নয়, তবে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনী অনুসারে এটি প্রায় ২০০ বছর আগে জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর সময় শুরু হয়েছিল। বিশ্বাস করা হয়, যখন কোনও মহিলা সিঁদুর খেলায় অংশগ্রহণ করেন, তখন তিনি বিধবা হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পান। এই আচারটি তাদের পরিবারকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে নারীদের শক্তির প্রতীক এবং বিরোধ নিষ্পত্তি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে বলে মনে করা হয়।
বিবাহিত মহিলারা তাদের পরিবারের সমৃদ্ধি এবং সুরক্ষার আশায় সিঁদুর খেলা উদযাপন করেন। সিঁদুর বিবাহিত জীবনের একটি শুভ প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। সুতরাং, এটি মাখলে নারীর পবিত্র বিবাহের শক্তি শক্তিশালী হয়। এটি বন্ধুত্বকেও উৎসাহিত করে এবং নারীত্বের শক্তির প্রতিনিধিত্ব করে।
তবে বর্তমান সমাজ মনে করে, মনের ইচ্ছে হলে দেবী দুর্গাকে যে কেউ বরণ করতে পারেন। এমন তো নয় যে কেউ পথ আটকাবে! সমাজচ্যুত হওয়ার ভয় কিংবা অশুচি তকমা পাওয়ার আশঙ্কা কাজ করে না অধিকাংশেরই মনে।
তর্ক তৈরি হয়, যে মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করল না সে-ও তো পুজোর নির্দিষ্ট কিছু কাজে ব্রাত্য। বিবাহ না করলে ধম্মকম্মেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। আবারও কারও কারও প্রশ্ন, সিঁদুর পরিয়ে দিলেই কি শুধু সিঁদুর খেলা যায়? আধুনিক মহিলারা বলছেন, কখনওই তেমনটা নয়। মনের ইচ্ছে হলে মায়ের পুজোয় নিজেকে যে ভাবেই হোক সামিল করা যায়।
ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, ৩৭ কোটি মেয়ে যৌন হেনস্থার শিকার। পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে পুরুষের নগ্নতা চাপা পড়ে গিয়েছে। এর সঙ্গে তার সম্মানহানির প্রশ্ন তো ওঠেই না। বরং সে কত ক্ষমতাশালী, সেই দিকটাই বড় হয়ে আসে।
অথচ বিধবা মহিলারা পুজো পার্বণে বা বিয়ের মতো অনুষ্ঠানে অংশ নিলে কিংবা দুর্গাপুজো সিঁদুর খেললে সেটিকে অশুভ ধরা হয়। তবে স্বামীর মৃত্যুর পরে মহিলারা লাল শাড়ি পরছে। মাংস খাচ্ছে। সিঁদুর খেলছে। এই দৃশ্য এখন আর বিরল নয়।
বারাসতের শঙ্কর চট্টোপাধ্য়ায়ের পুজোর পোশাকি নাম শিবের কোঠার দুর্গাপুজো। এই পুজোয় কেবল সধবারা নন, সিঁদুর খেলার অনুমতি রয়েছে পাড়ার বিধবাদেরও।