ডাক্তার নির্মল কুমার সাহা। বহরমপুরে ৩৩ বছর ধরে ডাক্তারি করছেন। তিনিই এবার বিজেপির প্রার্থী। লড়বেন ৫ বারের সাংসদ তথা কংগ্রেস প্রার্থী অধীর চৌধুরী ও তৃণমূলের ইউসুফ পাঠানের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, বহরমপুরে এবার ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা। কারণ, গত বিধানসভা ভোটে বিজেপির ফলাফল ও লোকসভায় তাদের প্রার্থী নির্বাচন। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বহরমপুরের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রেই ভোটের নিরিখে তৃতীয় স্থান পায় কংগ্রেস। প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় তৃণমূল ও বিজেপি। অধীর গড় বলে পরিচিত বহরমপুর বিধানসভাও দখল করে বিজেপি। ফলে এবার বহরমপুর লোকসভা নিয়ে টানটান উত্তেজনা। বিজেপি কি সত্যিই ফ্যাক্টর হতে চলেছে বহরমপুরে? অধীর বা ইউসুফকে টেক্কা দিতে পারবে? গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী ডাক্তার নির্মল কুমার সাহা নিজেই জানালেন সেই কথা।
প্রশ্নঃ আপনার বিপক্ষে রয়েছেন তৃণমূলের ইউসুফ পাঠান, আর পাঁচবারের সাংসদ অধীর চৌধুরী। কী মনে হচ্ছে বিজেপি আপনাকে জোড়া বাঘের মুখে ফেলে দিল?
নির্মল সাহা: না না। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে বিজেপি কখনওই বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে খুব শক্তিশালী প্রার্থী দিতে পারেনি। একবারই কর্নেল সব্যসাচী বাগচী ছিলেন। মানুষের সব থেকে বড় অভিযোগ ছিল, বহরমপুরে বিজেপি ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করে না। ফলে রাষ্ট্রবাদী যে ভোট আছে, সেই ভোটটা ঠিক মতো পেত না। এবার সেটা হয়নি। আমি ছোটো থেকেই বিজেপি-র ভাবধারায় বিশ্বাসী। তখন জনসংঘ ছিল। জয়প্রকাশ নারায়নের নেতৃত্বে যে আন্দোলন হয়েছিল আমি তার শরিক ছিলাম। আমরা অনেক কিছু করেছিলাম তখন। একটা সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলাম, জেল ভরো আন্দোলন করেছিলাম অনেকে জেলে গেছিল। বন্দেমাতরম-এর শতবর্ষে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মূর্তি বহরমপুর পৌরসভার সামনে আমরাই বসিয়েছিলাম। তারপর আমি পড়াশোনার জন্য বাইরে যাই। কলেজ রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত হই। তারপর চাকরিতে ঢুকি। তারপর আমার মনে হয়েছিল, আক্ষরিক অর্থে রাজনীতি করাটা বোধ হয় ঠিক নয়। এমনিতেও আমি সরকারি চাকরি করতাম। তাই প্রত্যক্ষ রাজনীতির সুযোগ ছিল না। তবে অবসর নেওয়ার পর সুযোগটা এল। আমাদের জেলা সম্পাদক আমাকে আফার দিলেন। আমিও চলে এলাম। আমার মনে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ আর কিছু নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, বিচার, কলকারখানা, কৃষি, খামার, মেয়েদের সন্মান কিছু নেই। গুন্ডাবাজি , তোলাবাজি, প্রোমোটারি রাজ করছে। সন্দেশখালি তারই প্রমাণ। এটা কোনও বিক্ষুব্ধ ঘটনা নয়। পরের প্রজন্ম কিন্তু আর পশ্চিমবঙ্গে থাকতে পারবে না। কোনও কাজ থাকবে না। কলকারখানা থাকবে না। এখন থেকেই সবাই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ আপনি কি RSS করতেন?
নির্মল সাহা: হ্যাঁ আর এস এস করতাম। কমিউনিস্টরা বলত ধর্ম নিরপেক্ষতা, অসাম্প্রদায়িক কিন্তু এটা শুধু সনাতনী হিন্দুদের জন্য। কোথায় সংখ্যালঘুদের ধর্ম নিরপক্ষতা নিয়ে তো কোনও কথা ওঠে না। সংখ্যালঘুদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে, তোষামোদ করে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে দশকের পর দশক। এটা চলতে পারে না। মানবতাই ধর্ম। দিনের শেষে মনে রাখতে হবে, আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটাই পালন করব। তবে তা যেন কারও সমস্যার কারণ না হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রের ধর্ম সংবিধান। রাষ্ট্রের যে উপাসনা গৃহ সেটা পার্লামেন্ট। কাশ্মীরে হিন্দুরা সংখ্যালঘু মুর্শিদাবাদে আমরা সংখ্যালঘু। কোনও নেত্রী যদি হিজাব পরে নেন কিংবা একটা চার্চে চলে যান তাহলে তিনি ধর্ম নিরপেক্ষ প্রমাণ হয়ে যাবে? মানুষ কে অত বোকা ভাবলে হবে না।
প্রশ্নঃ কিন্তু আপনি যে কেন্দ্র থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সেই কেন্দ্রের সাতটি বিধানসভা আছে তার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধানসভায় তথাকথিত সংখ্যালঘু লোকদের বাস বেশি।
নির্মল সাহা: সংখ্যালঘু শব্দটি আমাকে বলবেন না। আমি সবাইকে মানুষ বলে মনে করি। সংখ্যালঘু মানুষ এমন বোকা নাকি যে তারা অন্ধের মতো শুধু সংখ্যালঘু প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। এটা হতে পারে না।
প্রশ্নঃ কিন্তু বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে রাজনৈতিক মেরুকরণ হয়েছে, এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না । বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রে যে সাতটি বিধানসভা আছে এর মধ্যে শুধু মাত্র বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্র বিজেপি জিতেছে। বাকি ছয়টি কেন্দ্রে বিধানসভায় জিততে পারেনি।
নির্মল সাহা: বড়ঞা বিধানসভায় বিজেপি জিতেছিল। রিকাউন্টিং করে বুথ দখল করে জীবনকৃষ্ণ দাস জেতে। তৃণমূল সব জায়গায় এভাবেই জিতেছিল। বিধানসভা ভোটে অনেক কারচুপি করছিলো তৃণমূল। এগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। তৃণমূল যা ভোট পেয়েছে সেটা প্রশাসনকে ব্যবহার করে। সব বিধানসভা মিলিয়ে কংগ্রেস মাত্র ২ লক্ষ ভোট পেয়েছে। আর বিজেপি পেয়েছিলো ৪ লক্ষ ২০ হাজার ভোট। অত সহজে ইউসুফ পাঠান জিতে যাবে আর আর বিজেপি হেরে যাবে, এটা হবে না। আমি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি পছন্দ করি না। তবে এত সহজে তৃণমূল মেরুকরণ করবে সেটাও হতে দেব না।
প্রশ্ন: কিন্তু রাজনৈতিক সমীকরণ, সংখ্য়া এই কথা বলছে না
নির্মল সাহা: আমি রাজনৈতিক সমীকরণের কথা ধর্মকে সামনে রেখে মানতে ভালোবাসি না। বিশ্বাসও করি না। আমি বিকশিত ভারতের কথা বলব, মানুষের উন্নতির কথা বলব, অর্থনীতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা বলব। আমি ভোট চাইব এই ভাবেই। এবার মানুষ যদি আমায় ভোট দেয় দেবে না দিলে অন্য কাউকে দেবে। তবে আমার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে না।
প্রশ্ন: আপনার প্রধান প্রতিপক্ষ বলে কাকে মনে করছেন?
নির্মল সাহা: আমি এরকম একদম ভাবছি না। মানুষকে এটা ভাবতে হবে। এটা তো পঞ্চায়েত বা পৌরসভা ভোট নয়। স্বাধীন দেশে সবাই সব জায়গা থেকে ভোটে দাঁড়াতে পারে। ইউসুফ পাঠানকে তার দল মনে করেছে এখান থেকে প্রার্থী করবে। আর অধীর দা এখানে ২৫ বছর আছে। মানুষ যদি জিজ্ঞাসা করে আপনাকে ভোট দিয়েছি কী কাজ করেছেন তখন তিনি কি বলবেন। তাকে তো বলতে হবে কী কী করেছেন।
প্রশ্ন: আপনাকে মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ ডাক্তার হিসেবে মসিহা মনে করে, সেই ইমেজ কাজে দেবে ?
নির্মল সাহা: মসিহা শব্দটি ব্যবহার করা হয় রবিনহুডদের। আমি ভগবান নয় আমায় সাধারণ মানুষ। আমি খুব মন দিয়ে ডাক্তারি করেছি। হৃদয় দিয়ে ডাক্তারি করতে হয়। আমি খুব খুশি আমার পেশা নিয়ে।
প্রশ্ন: অধীর চৌধুরী কি কোনদিন আপনার পেসেন্ট ছিলেন?
নির্মল সাহা: হ্যাঁ ছিলেন। ওঁর মেয়ে বেঁচে থাকাকালীন ওঁকে দেখেছি। এখনও কখনও সখনও দরকারে ফোন করেন।
প্রশ্ন:আপনি প্রার্থী হবার পর কি আপনার সাথে কথা হয়েছে ওঁর?
নির্মল সাহা: হ্যাঁ কথা হয়েছে।
প্রশ্ন: কী বললেন?
নির্মল সাহা: এইগুলো একদমই ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আমি ভোটে দাঁড়ানোর পর অনেক জনই শুভেচ্ছে জানিয়েছেন। অধীরদাও জানিয়েছেন। বিস্তারিত কী কথা হয়েছে সেটা না হয় থাক।
প্রশ্ন: ইউসুফ পাঠানের সঙ্গে দেখা বা কথা হয়েছে?
নির্মল সাহা: না দেখা হয়নি
প্রশ্ন: আপনি আপনার জয়ের বিষয়ে কতটা আশাবাদী?
নির্মল সাহা: আমি আমার বক্তব্য মানুষকে বলব। জনতা সব। আমার মনে হয় তারা বুদ্ধিমান। তারা জানেন, কাকে ভোট দিতে হবে। আমার আশা করা বা নিরাশ হওয়ার কোনও জায়গা নেই। আমি অতি আনন্দে হাহা করে উঠি না দুঃখে কাতর হয় না। রোগীদের দেহ হচ্ছে আমার কাছে ক্যানভাস। ছুরি, কাঁচি হচ্ছে আমার কাছে তুলি। জীবনটা আমি এভাবেই দেখি। তবে এটাও বলব যে, সহজে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র আমি নই। ইউসুফ হোক বা অধীরদা, ভোটের ময়দানেই দেখা যাবে।