আগামী ১ জুন লোকসভা নির্বাচনের সপ্তম দফার ভোট। আর এই শেষ দফার নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ৯টি আসনে লড়াই। ভোট পর্বের শেষ দিনে বাংলায় একগুচ্ছ হেভিওয়েট প্রার্থীর পরীক্ষা হতে চলেছে। আগে জেনে নেওয়া যাক, ১ জুন ২০২৪-এ পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন আসনে ভোট।
১ জুন পশ্চিমবঙ্গের কোন কোন আসনে ভোট
শনিবার রাজ্যের ৯টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হবে। এদিন কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, দমদম, বারাসত, ডায়মন্ড হারবার, মথুরাপুর, বসিরহাট, জয়নগর ও যাদবপুরে ভোট হবে।
কলকাতা উত্তর কেন্দ্রে তৃণমূলের আস্থা তিনবারের সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Sudip Bandyopadhyay) উপরকেই। ২০১৯ সালে শেষ লোকসভা নির্বাচনে একাই ৫০% ভোট পেয়েছিলেন সুদীপ। বিজেপির রাহুল সিনহা ৩৭% ভোট পান। ফলে এই কেন্দ্রে যে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূলের বড় শক্তি, তা বলাই বাহুল্য। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও কলকাতা উত্তরের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রই তৃণমূলের দখলে যায়। ফলে এই কেন্দ্রে যে তৃণমূলের জোর ভালই, তা বলাই যায়।
তবে এবার পাল্টা প্রার্থীতে চমক দিয়েছে বিজেপি। সদ্য তৃণমূল ছাড়া প্রাক্তন বিধায়ক তাপস রায় (Tapas Roy) এবার সুদীপের বিরুদ্ধে প্রার্থী। ফলে দুই প্রাক্তন সহযোদ্ধার লড়াই কেমন হয়, সেটাই দেখার।
কলকাতা দক্ষিণ
দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা পুরসভার ৫৮টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ২৬টি ওয়ার্ড বিজেপি এগিয়ে ছিল। ফলে এই এলাকাগুলিতে আসন ফিরে পাওয়াটাই এখন তৃণমূলের বড় চ্যালেঞ্জ। আর সেটাতেই বিশেষ নজর তৃণমূল প্রার্থী মালা রায়ের। এই ২৬টি ওয়ার্ডেই বিশেষ নজর দিয়েছেন বিদায়ী সাংসদ।
কলকাতা দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী। ২০১৯-এর ফলাফলকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তাঁর লক্ষ্য।
দমদম
দমদম লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের ভরসা বর্ষীয়ান সৌগত রায়ে। ২০০৯ সালে সিপিএম-এর থেকে এই কেন্দ্র ছিনিয়ে আনেন সৌগত। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপি চোরা স্রোতই এবার তৃণমূলের বড় চ্যালেঞ্জ হতে চলেছে। এমনিতেই বরানগর বিধানসভা থেকে তাপস রায় বিজেপিতে গিয়েছেন। ব্যারাকপুর-দমদম সাংগঠনিক জেলার দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ফলে সেটা সংগঠনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিজেপির এই উত্থানকে কাজে লাগিয়েই কোমর বেঁধে নেমেছেন দমদম কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শীলভদ্র দত্ত।
সিপিএম-এর এখানে হেভিওয়েট প্রার্থী সুজন চক্রবর্তী।
বারাসত
বারাসাতে প্রতিপক্ষদের তুলনায় এগিয়ে তৃণমূলের প্রার্থী কাকলি ঘোষ দস্তিদার। এই কেন্দ্রের বিদায়ী সাংসদ তিনি। টানা তিনবার এই আসন থেকে জিতেছেন তিনি। ফলে বারাসাত কেন্দ্রটা যে তৃণমূলের বাঁধন ভালই, তা বলাই যায়। বারাসাতের সাতটি বিধানসভাই ঘাসফুল শিবিরের দখলে। বিশ্লেষকদের মতে, সংখ্যালঘু এবং মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোটাররাই এখানে তৃণমূলের বড় শক্তি।
অন্যদিকে তাঁর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী স্বপন মজুমদার। গত কয়েক বছরে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের সাজানো বাগানে বাড়ছে পদ্মের দাপট। বারাসাত কেন্দ্রের অন্তর্গত হাবড়ার বিধায়ক তথা রাজ্যের বনমন্ত্রীর জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক জেলে। দুর্নীতিকেই তাই এই আসনে ইস্যু করে এগোচ্ছেন স্বপন মজুমদার।
বাম প্রার্থী সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। বারাসাত পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান তিনি। পুরনো রাজনীতিবিদ হলেও বামেদের সাংগঠনিক দুর্বলতা রয়েছে।
ফলে টানা চারবার বারাসাতে জেতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী কাকলি ঘোষ দস্তিদার। সেই রেকর্ড তিনি গড়তে পারেন কিনা, তা আগামী ১ জুনের ভোটের পরেই বোঝা যাবে।
ডায়মন্ড হারবার
ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের হেভিওয়েট প্রার্থী অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্যায়। ২০১৯ সালে এই কেন্দ্র থেকে ৭.৯০ লক্ষ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। তাঁর তুলনায় প্রায় ৩ লক্ষ ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে ছিলেন পদ্মশিবিরের নীলাঞ্জন রায়।
আর এবার গেরুয়া শিবিরের বিজেপি প্রার্থী অভিজিৎ দাস ওরফে ববি। একেবারে মাটির স্তর থেকে রাজনীতি করে উঠে এসেছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিষেকের তুলনায় তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিশমা, পরিচিতি কম। ফলে বিজেপির যে চ্যালেঞ্জ রয়েছেই, তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে এই কেন্দ্রে বাম প্রার্থী প্রতীর উর রহমান।
মথুরাপুর
ভোট-বঙ্গে ২০ তম ও শেষ জনসভা এই মথুরাপুরেই করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অশোক পুরকায়স্থ।
মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের বেশিরভাগটাই জল-জঙ্গলে ঘেরা। নদীনালা বেষ্টিত সাগর ও পাথরপ্রতিমার মানুষের পরিকাঠামো, যাতায়াত ব্যবস্থা নিয়ে বহুদিন ধরে নানা দাবি। ২০২১-এর লোকসভা ভোটের প্রচারে এসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেই বিষয়ে নানা আশ্বাস দেন। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি মথুরাপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বাপি হালদারের সমর্থনে জনসভায় যাতায়াতের ইস্যু নিয়ে মুখ খোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, 'গঙ্গাসাগরে যা যা করার দরকার ছিল, করে দিয়েছি। বাকি শুধু মুড়িগঙ্গা নদীতে সেতু। একটু সময় লাগবে। সেতু তৈরির জন্য সার্ভে হয়ে গিয়েছে। আশা করি, আগামী দু'তিন বছরের মধ্যে সেতু তৈরি হয়ে যাবে।' এই সেতু নির্মাণে ১৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অপেক্ষা না করে নিজেরাই এই সেতু করবেন বলে জানান মুখ্যমন্ত্রী।
বসিরহাট
বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্র বললেই এখন রাজ্য-রাজনীতিতে যে শব্দটা মাথায় আসে, সেটা হল 'সন্দেশখালি'। সিপিএম ও বিজেপি দুই দলেরই এবার তুরুপের তাস সন্দেশখালির প্রতিবাদী মুখ। যদিও বিভিন্ন ভিডিও ফাঁস, টাকা দিয়ে প্রতিবাদী মহিলা সাজানোর অভিযোগ-বিতর্কে সেই দাপট কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে।
যদিও প্রতিবাদী মুখকে কাজে লাগিয়েই বসিরহাটে পদ্ম ফোটাতে চাইছে গেরুয়া শিবির। তাদের ভরসা 'গ্রামের মেয়ে' রেখা পাত্রের উপর। বসিরহাটে জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদীর পাশেই বসেছিলেন রেখা। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে, তাঁর আগে ভাষণও দেন। রেখার ভাষণের ভূয়সী প্রশংসাও করেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, 'শেখ শাহজাহানদের সাহস আটকাতে রেখাকে আমাদের সংসদে পৌঁছে দিতে হবে।'
অন্যদিকে সন্দেশখালির আরেক প্রতিবাদী মুখ নিরাপদ সর্দারকে এখানে প্রার্থী করেছে সিপিএম। তৃণমূল কংগ্রেসের ভরসা হাজি নুরুল ইসলামের উপর।
সন্দেশখালি ঝড়ের পর বসিরহাটে আগামী ১ জুন কী রায় দেবেন সেখানকার মানুষ? ফলাফল বের হওয়ার পরেই তা জানা যাবে।
জয়নগর
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল এই আসনে ৩ লাখ ১৬ হাজার ভোটে জিতেছিল। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনেও এগিয়ে ছিল সবুজ দলই। জয়নগরে বিজেপি প্রার্থী অশোক কান্ডারী। অন্যদিকে তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মণ্ডল। প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ, যাতায়াত ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা উন্নত করাই সবচেয়ে বড় ইস্যু।
যাদবপুর
রাজ্য-রাজনীতির অন্য়তম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এই যাদবপুর লোকসভা। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী সায়নী ঘোষ। সাংগঠনিক দিক থেকে গত কয়েক মাসে পায়ের তলার মাটি অনেকটাই শক্ত করেছেন তারকা প্রার্থী।
অন্য়দিকে যাদবপুরে এবারে বামেরা প্রার্থী করেছে সৃজন ভট্টাচার্যকে৷ ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে এসেছেন। ঘরের ছেলের মতো আচরণ, তরুণ তুর্কি হিসাবে সৃজনের ভালই জনপ্রিয়তা রয়েছে। সায়নীকে টেক্কা দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট কিনা, সেটাই দেখার।
বিজেপির প্রার্থী হয়েছেন অনির্বাণ গাঙ্গুলি। ২০২১ সালে বোলপুর থেকে বিধানসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।