অপূর্ব সরকার। মুর্শিদাবাদে ডেভিড নামেই বেশি পরিচিত। পরপর ৩ বাারের বিধায়ক। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর ডানহাত বলে পরিচিত ছিলেন একসময়। তবে ২০১৮ সালে 'দাদা'-র হাত ছেড়ে নাম লেখান তৃণমূল কংগ্রেসে। ২০১৯ লোকসভা ভোটে অপূর্বই বহরমপুর কেন্দ্রে অধীরের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে ৮০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। পরাজিত হলেও তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আস্থা হারাননি ডেভিডের উপর থেকে। এর কারণও রয়েছে। ২০১৪ সালে এই লোকসভা আসন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী করেছিলেন গায়ক ইন্দ্রনীল সেনকে। সেবার অধীর তাঁকে ৩ লাখেরও বেশি ভোটে হারিয়ে দেন। কিন্তু, উনিশের ভোটে অপূর্ব পরাজিত হন অনেক কম ভোটে ভোটে। জেলা তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি, উনিশের ভোটে তাঁদের প্রার্থী অধীরের মতো দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার কাছে খুব 'সামান্য' ভোটে হেরেছেন। তাই এবারও কান্দি বিধানসভা ভোটে সেই অপূর্বকেই প্রার্থী করেছে ঘাসফুল শিবির। এবার তাঁর প্রতিপক্ষ অধীরের 'খাস লোক' সফিউল আলম খান। বিজেপির হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে গৌতম রায়। গৌতম রায়ও একসময় কংগ্রেস করতেন। পরে তৃণমূলে যান। এখন তিনি গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী। একদা দুই সতীর্থের বিরুদ্ধে এবারের ভোটে লড়া নিয়ে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দিলেন অপূর্ব সরকার।
প্রশ্ন: একসময় গৌতম রায় ও সফিউল আলম খান আপনার রাজনৈতিক সঙ্গী ছিলেন। এখন তো প্রতিপক্ষ?
অপূর্ব: দেখুন একসময় সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু এখন রাজনীতির ময়দান বদলেছে। আমি তৃণমূল প্রার্থী। ওরা অন্যদলের। রাজনীতি রাজনীতির জায়গায়।
প্রশ্ন: দেখা-সাক্ষাৎ হলে কথা বলেন?
অপূর্ব : ওভাবে ভাবিনি কোনওদিন। এক শহরের মানুষ আমরা। দেখা হতেই পারে। রাজনীতি আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো এক জিনিস নয়। তবে এখন ওদের সঙ্গে কথা হয় না।
প্রশ্ন: আর অধীর চৌধুরীর সঙ্গে? তিনিই তো আপনার গুরু ছিলেন একসময়, হাতে করে রাজনীতিতে এনেছিলেন..
অপূর্ব: এটা আপনাদের ভুল ধারণা। আমাকে ২০০০ সালে কান্দি পৌরসভাতে টিকিট দেন স্বর্গীয় অতীশ চন্দ্র সিনহা। তিনিই রাজনীতিতে জায়গা করে দিয়েছিলেন।
প্রশ্ন: কিন্তু ২০০৬ সালে তো আপনি নির্দল প্রার্থী ছিলেন। সেইবার তো আপনার হয়ে প্রচার করেছিলেন অধীর চৌধুরী..
অপূর্ব : হ্যাঁ করেছিলেন। অস্বীকার করিনি তো। কিন্তু, এটাও মনে রাখবেন, নিজের স্বার্থে করেছিলেন। কান্দিকে হাতে রাখতে গেলে তাঁর আমাকে প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন: একথা কেন বলছেন?
অপূর্ব: আমি পরপর ৩ বার বিধায়ক ছিলাম। তার অনেক আগে থেকে আমার সঙ্গে অধীর চৌধুরীর সম্পর্ক ছিল। আমার বাড়ির সঙ্গে ওঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমি ওঁকে চিনি। উনি নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারেন। একজন ক্ষমতালোভী মানুষ। দিনের পর দিন আমাকে ব্যবহার করেছেন। নিজের ইমেজ বিল্ডিংয়ের জন্য আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। শারীরিক, মানসিক, আর্থিক সবরকমভাবে কংগ্রেসকে সাহায্য করেছি। দলের সৈনিক ছিলাম। কিন্তু, অধীর চৌধুরী সেইসবের সম্মান দেননি আমায়। শুধু নিজের স্বার্থ দেখেছেন। ইমেজের খেয়াল রেখেছেন।
প্রশ্ন: কিন্তু, রবিনহু়ড ইমেজ তো আগে থেকেই ছিল অধীরবাবুর?
অপূর্ব: সেসব তো আমাদেরই বানানো। আমাদের মাথায় পা দিয়ে উনি নিজেকে ব্র্য়ান্ড বানিয়েছেন। কিন্তু, সেইসব আর নেই। এখন ওঁর পায়ের তলার মাটি নেই। গত লোকসভা ভোটে তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমি অধীরবাবুর থেকে ৪টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিলাম। জেলার বাকি ২টো আসনেও অধীর চৌধুরী কিছুই করে দেখাতে পারেননি। ওসব অধীর ক্যারিশমা আর নেই।
প্রশ্ন: গত লোকসভায় আপনার কান্দি বিধানসভাতেই তো লিড দিতে পারেননি, তাহলে এবার আপনি এখান থেকে জিতবেন কেন ভাবছেন?
অপূর্ব: নিশ্চয় আমাদের ভুলভ্রান্তি ছিল। তাই এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠের মত আমাদের পক্ষে যায়নি। তবে আমি হেরে গেলেও মানুষের সঙ্গে থেকেছি। কাজ করেছি। করোনার সময় অধীর চৌধুরী কোথায় ছিলেন? গত বিধানসভা উপনির্বাচনে বনু খাঁ (সফিউল আলম খান) জিতলেন। কিন্তু মানুষের জন্য কিছুই করেননি। অধীরবাবুও আসেননি। আমি রাস্তায় বেরিয়েছি। মানুষকে সাধ্যমতো সাহায্য করেছি। দল আমাকে সাহায্য করেছে।
প্রশ্ন: অধীরবাবুকে আগে দাদা বলতেন, এখন....
অপূর্ব: যখন বলতাম তখন বলতাম। এখন আর বলি না। বলবও না।
প্রশ্ন: আর কোনওদিন দেখা হলে কথাও বলবেন না?
অপূর্ব: প্রশ্নই উঠছে না। আমার দেখা করার বা কথা বলার কোনও ইচ্ছে নেই। ওরকম একজন স্বার্থপরের সঙ্গে।
প্রশ্ন: এত তিক্ততা অধীর চৌধুরীর উপর?
অপূর্ব: হ্যাঁ। এতটাই। আপনারা জানেন কি না জানি না, কংগ্রেস ছাড়ার আগে শেষ কয়েক মাস আমাকে চরম অপমান করা হয়েছে। আমাকে কোনও মিটিংয়ে ডাকা হয়নি। অসম্মান করা হয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করা আমার লক্ষ্য। তাই দল ছেড়েছি। অপমান নিয়ে থাকতে পারিনি। রাহুল গান্ধিকে একাধিকবার জানিয়েছি আমাকে অপমান করা হয়েছে সেকথা। কিন্তু, কিছু হয়নি।
প্রশ্ন: কেন ডাকত না মিটিংয়ে?
অপূর্ব : ম্যাডামের বশ্যতা স্বীকার করিনি তাই। আমাকে দলে কোণঠাসা করার চেষ্টা করা হয়।
প্রশ্ন: ম্য়াডাম মানে?
অপূর্ব: কে আবার? অধীর চৌধুরীর দ্বিতীয় স্ত্রী। তখন যদিও স্ত্রী ছিলেন কিনা জানি না। তবে উনিই তো দল চালাতেন।
প্রশ্ন: একথা বিশ্বাসযোগ্য?
অপূর্ব: যারা আমার সঙ্গে কংগ্রেস ছেড়েছেন তাদের জিজ্ঞেস করে দেখুন। কিছু জিজ্ঞাসা করলেই ম্যাডামকে ফোন করতে বলতেন। রাশ তো ম্যাডামের হাতেই ছিল। অধীর চৌধুরী কেবলমাত্র হাতের পুতুল। এখনও সেভাবেই কংগ্রেস দলটা চলে।
প্রশ্ন: গৌতম রায় আপনার পরিচালিত পৌরসভার সদস্য ছিলেন। তাঁকেও তো গত উপনির্বাচনে জেতাতে পারলেন না?
অপূর্ব: আমাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। সবরকম সাহায্য করেছি। আমি নিজেও প্রচার করেছি। কিন্তু, মানুষ ভোট দেয়নি।
প্রশ্ন: এবার তো গৌতমবাবু বিজেপির প্রার্থী, উনি কেন তৃণমূল ছাড়লেন?
অপূর্ব: দেখুন, দল ছাড়তেই পারে। এটা ওঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে আমি দেখেছি এঁরা সুবিধাবাদী রাজনীতি করেন। যেখানে সুবিধা সেখানে যান।
প্রশ্ন: একই অভিযোগ তো আপনার বিরুদ্ধেও ওঠে?
অপূর্ব: কংগ্রেস ছাড়ার কারণ আমি তো আগেই আপনাকে বলেছি। তৃণমূল আমাকে অনেক বেশি সম্মান দিয়েছে। হেরে যাওয়ার পরও দলনেত্রী আমার উপর আস্থা রেখেছেন। এটাই তো চাই। এই সম্মানটুকুই তো প্রত্যাশা করি। যেটা দল আমাকে দিয়েছে। দিয়ে চলেছে।
প্রশ্ন: মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা হয়?
অপূর্ব : হ্যাঁ। বহুবার। দিদির সঙ্গে দেখা হলেই প্রণাম করি। দিদি আমাকে বলেছেন, কোনও চিন্তা নেই। মন দিয়ে মানুষের কাজ করো। আমিও সেই নির্দেশ মেনে চলছি।
প্রশ্ন: স্মৃতি ইরানি তো বলেছেন কান্দিতে রেল করে দেবেন..
অপূর্ব (মৃদু হেসে): উনি জানেন কীভাবে কী হয়? ভোট পাওয়ার জন্য মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। এই জেলা নিয়ে কোনও ধারণাই নেই ওঁর। মুখে বড় বড় কথা বলা আর মানুষের সঙ্গে থাকার মধ্যে বিস্তর ফারাক আছে।
প্রশ্ন: বিজেপি তো বলছে আপনি ও আপনার ভাই গোটা কান্দি দখল করে বসে আছেন?
অপূর্ব: দেখুন , আমি যা করেছি নিজের যোগ্যতায়। রাজনৈতিক লড়াই করেছি। মানুষের সঙ্গে থেকেছি। কাজ করেছি। আজও করছি। এটাই আমার জীবনের ব্রত। কে কী বলল, ওসব ভাবি না।
প্রশ্ন: বিজেপি না কংগ্রেস কে আপনার প্রতিপক্ষ?
অপূর্ব: কংগ্রেস, বাম, বিজেপি এরা এখানে জোট বেঁধেছে। সব সেটিং করে নিয়েছে। ওদের লক্ষ্য আমাকে হারানো।
প্রশ্ন: জিতবেন?
অপূর্ব: ওই যে বললাম মানুষের সঙ্গে থেকেছি। সারাবছর কাজ করেছি। ৯০ শতাংশ জায়গায় হেঁটে হেঁটে প্রচার করছি। ও আমার দলের লোক, ও অন্য দলের লোক- এসব বাছবিচার না করেই কাজ করেছি।
প্রশ্ন: উত্তর কিন্তু পেলাম না
অপূর্ব: ২ মে উত্তর পেয়ে যাবেন। আর হ্যাঁ, সেদিন মিষ্টিমুখ করে যাবেন। আগাম নিমন্ত্রণ রইল।