'ছিট' শব্দটির একটি অতি সাধারণ অর্থ রয়েছে। ফাউন্টেন পেন থেকে যদি আপনি একটি সাদা কাগজের ওপর কালি ছেটান তাহলে তাকে গোদা বালায় ছিট বা ছিটে বলা হয়। ব্রিটিশ যুগে বাংলার বুকে ঠিক এমনই কিছু এলাকা তৈরি হয়েছিল যা তৎকালীন রাজাদের কাছে কালির দাগের মতোই ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে এই এলাকাগুলিকেই 'ছিটমহল' রূপে জানা যায়। কোচবিহার জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এই ছিটমহলগুলিতে ১৯৪৯ থেকে ২০১৫-র গোঁড়ার দিক পর্যন্ত অবস্থা ছিল ভয়াবহ। অবশেষে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তির বলে হস্তান্ত হয় ছিটগুলি এবং সেই সঙ্গে বৈধতা পায় সেখানকার বাসিন্দারা। সংখ্যায় অতি সামান্য হলেও, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের মতোই এবারের ভোটের উন্নয়ের প্রশ্নেই নিজেদের মতাধিকার প্রয়োগে নামবেন ছিটমহলের বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল---
শুধু ছিটমহল নয়, কখনও কখনও এদের পাশা ছিটমহলও বলা হয়ে থাকে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বরাবর থাকা এই ছিটমহলগুলি মূলত বাংলাদেশের কিছু অংশের পাশাপাশি, ভারতের কোচবিহার, ত্রিপুরা, অসম ও মেঘালয়ে ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ভারতীয় ভূখণ্ডের ১০২টি ছিট। এর মধ্যে ২১টি বাংলাদেশী কাউন্টার ছিটমহল ছিল। ভারতের মূল ভূখণ্ডে ৭১টি বাংলাদেশী ছিটমহল ছিল। এদের মধ্যে আবার ৩টি ভারতীয় কাউন্টার ছিটমহল। ২০১০ সালের দুই দেশের একটি যৌথ আদমশুমারিতে দেখা গিয়েছে, এই ছিটমহলগুলোতে ৫১,৫৪৯ জন মানুষ বসবাস করেন। তারমধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলে ৩৭,৩৩৪ জন এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশী ছিটমহলে ১৪,২১৫ জন।
২০১৫ সালের পয়লা অগাস্টের আগে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের সর্বমোট ১৬২টি ছিটমহল ছিল। ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীরা ১৯৭৪ সালে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন ছিটমহল বিনিময় এবং তাদের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সরলীকরণের জন্য। ৭ই মে, ২০১৫ ভারতীয় সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী পাস করার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তির একটি সংশোধিত সংস্করণ গ্রহণ করা হয়। এই চুক্তি অনুসারে ২০১৫ সালের ৬-ই জুন ভারতের মূল ভূখণ্ডে থাকা ৫১টি বাংলাদেশী ছিট নিজেদের অধীনে পেয়ে যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে থাকা ১১১টি ভারতীয় ছিট সেদেশের স্থায়ী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হয়। চুক্তি অনুসারে ছিটমহলের বাসিন্দারা হয় তাদের বর্তমান অবস্থানে বসবাস চালিয়ে যেতে পারেন, অথবা তাদের পছন্দের দেশে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। ছিটমহল বিনিময় ৩১ জুলাই ২০১৫ থেকে ৩০ জুন ২০১৬ মধ্যে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার কথা হয়। এরপর, ১ অগাস্ট রাত ১২ বেজে১ মিনিটে দুই দেশ ঐতিহাসিক মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির আওতায় একে অন্যের অভ্যন্তরে থাকা নিজেদের ছিটমহলগুলিকে পরস্পরের সাথে বিনিময় করে এবং ছিটমহলের বাসিন্দাদের স্থানান্তর সম্পন্ন করে।
প্রসঙ্গত, বিনিময়ের সময় উল্লেখযোগ্য ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম ও ভারতের ছিটমহল দাশিয়ারছড়া। দাশিয়ারছড়ার ভেতরেই আছে চন্দ্রখানা নামের বাংলাদেশের একটি ছিটমহল যেটি বাংলাদেশেই থেকে যায়। এই বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ এবং নাগরিকত্বহীনতা থেকে মুক্তি পান ১৬২টি ছিটমহলের অধিবাসীরা। মূলত, এই সঙ্কট তৈরি হয় অখণ্ড ভারতকে টুকরো করার সময়। গোড়ায় গলদটা রেখে যায় ব্রিটিশরাই। তারাই পাকিস্তান-ভারত সীমানা নির্ধারণ করে। সেই সঙ্গে সৃষ্টি করে এক অসহনীয় মানবিক সমস্যার। অঞ্চল বিনিময়এর পর একমাত্র অবশিষ্ট ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গারপোতা
জনসংখ্যার নিরিখে---
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত তৈরির সময় র্যাডক্লিফ মানচিত্র বিভাজন থেকেই উদ্ভব হয় ছিটমহলগুলির। এক দেশের ভূখণ্ডে থেকে যায় অন্য দেশের অংশ। ১৬২টি ছিটমহল ছিল ভারত ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের(বর্তমানে বাংলাদেশ) মধ্যে দেশে। এর মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। আর বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল ভারতের অভ্যন্তরে। এসব ছিটমহলে বসবাসকারী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫১ হাজার। ২০১১ সালের জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিটমহলে বসবাসরত লোকসংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলের লোকসংখ্যা ছিল ১৪ হাজার। এই ছিটমহলগুলির মধ্যে লালমনিরহাটে ৫৯ টি, পঞ্চগড়ে ৩৬ টি, কুড়িগ্রামে ১২ টি ও নীলফামারিতে ৪টি ভারতীয় ছিট ছিল। অপরদিকে বাংলাদেশের ৫১টির মধ্যে ৪৭টি কোচবিহার ও ৪টি জলপাইগুড়ি জেলায় ছিল।
ছিটমহলের ইতিহাস---
ছিটমহলের ইতিহাস নিয়ে একাধিক গল্প রয়েছে। বলা হয় এই ছিটগুলি শতাব্দী প্রাচীন। তৎকালীন সময়, দুই আঞ্চলিক রাজা, কোচবিহারের রাজা এবং বাংলাদেশের রংপুরের মহারাজার মধ্যে পাশা খেলার সময় বাজি রাখা হত এই এলাকাগুলিকে। হার-জিতের ওপর নির্ভর করেই হস্তান্তর হত ছিটগুলি। । যদিও, ঐতিহাসিক রেকর্ডের ক্ষেত্রে, ছোট অঞ্চল কোচবিহার ও তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের মধ্যে ১৭১৩ সালের চুক্তি হয়। সেখানেই এই জমি নিয়ে একটি একটি বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সম্ভবত, কোচবিহারের রাজার সঙ্গে মুঘলদের যুদ্ধে কোনও অঞ্চল জয় বা হারের সীমানা নির্ধারণ না করেই যুদ্ধ শেষ করে দেওয়া হয়। ফলে কোচবিহার রাজ্যের কোচ রাজার জমিদারির কিছু অংশ রাজ্যের বাইরের চলে যায়। ভারত ভাগের পর ওই এলাকাগুলি পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেগুলিই পরবর্তীতে ছিটমহল রূপে উঠে আসে।
ছিটমহল নিয়ে বিভ্রান্তি কাটাতে কমিটি---
ছিটমহলের তালিকা ১৯৯৭ সালে দুই দেশ দ্বারা প্রস্তুত করা হয়। ২০০১ সালে ছিটমহলের তথ্য বিস্তারিত জানার জন্য দুটি যৌথ সীমানা ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। ২০০৭ সালে মে মাসে একটি যৌথ আদমশুমারি সম্পন্ন করা হয়। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তির জন্য অতিরিক্ত প্রোটোকল স্বাক্ষর করে। উভয় দেশ ১৬২টি ছিটমহল অদলবদল করার অভিপ্রায় ঘোষণা করে, যাতে বাসিন্দাদের জাতীয়তা পছন্দ সুযোগ রয়েছে।
এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৮ সালে সই হওয়া চুক্তিতে ছিটমহল বিনিময়ের উল্লেখ থাকলেও এ ব্যাপারে ভারতের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১৪৩ধারা সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত চান। তখন আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সংশোধনীর মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে হবে। যদিও তা পরবর্তী সময় নানা কারণে বিলম্বিতি হয়।
২০১৫ সালের চুক্তির পর বর্তমান পরিস্থিতি ছিট মহলে---
২০১৫ সালে চুক্তির বলে দুই দেশের মধ্যে ১৬২টি ছিট হস্তান্তর হওয়ার পর থেকেই সেখাকার বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে শেষ হতে থাকে তাঁদের সেই অসহনীয় যন্ত্রণা। একটা সময় যারা ভাল খাবার, পোশাক থেকে স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা কার্যত ছেড়েই দিয়েছিলেন, তারাই এবার নতুন করে বাঁচার রসদ খুঁজে পেতে থাকেন এই হস্তান্তরের ফলে। নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়ার পাশাপাশি ২০১৯ লোকসবা নির্বাচন থেকে ভোটাধিকারের সুযোগও মেলে এই বাসিন্দাদের। মেলে উন্নয়নের আশ্বাসও। তবে, চুক্তি ও ছিট হস্তান্তরের কাজ শেষ হয়েছে ৫ বছর হয় গেল। ২০১৯ সালে ভোটও দিলেন তাঁরা। তারপরও কি মিলেছে উন্নয়নের জোয়ার? সহজ কথায় বলতে গেলে না। এদিকে রাজবংশী সম্প্রদায় অন্যদিকে সংখ্যালঘুদেরই বাস এই ছিটমহলগুলিতে। এলাকার বাসিন্দা ফিরোজা বিবি বলেন, প্রতিশ্রুতিটুকুই মিলেছে রাজ্যের পক্ষ থেকে। উন্নয়ন চোখে দেখা হয়নি। একই কথা শোনা যায়, দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দীপ্তিময় সেনগুপ্তের গলায়। বর্তমানে তিনি বিজেপির সদস্য। তিনি বলেন, কেন্দ্রের তরফে ছিট মহলে উন্নয়নের জন্য ৮০০ কোটি টাকার বেশি দেওয়া হয়েছে। তবে, সেই টাকার সিকি ভাগও দেখা যায়নি। সবটাই কাটমানি হয়ে স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের পকেটে ঢুকেছে। যদিও, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সেই দাবিকে সম্পূর্ণ ভাবে নস্যাৎ করা হয়েছে। দিন দুয়েক আগেই কোচবিহারের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেন, ছিটমহল সমস্যার সমাধান তাঁর সরকারের হাত ধরেই হয়েছে।
তবে, বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে এখানকার ১৭ হাজার ভোটের অধিকাংশই গিয়েছে বিজেপির দখলে। যদিও, ২৯৪ আসনের জন্য এই সংখ্যক ভোট নিতান্তই নগন্য, তবুও নাগরিকত্ব পেয়েও কেন্দ্র-রাজ্য টানাপড়েনের মাঝে আজও উন্নয়নের থেকে বহু দূরে এখানকার মানুষগুলো।