বাংলায় ভোটরঙ্গ জমে গিয়েছে। জমিয়ে প্রচার চলছে শাসক-বিরোধী সব শিবিরেই। আর এর মাঝেই মোদীর দু'দিনের বাংলাদেশ সফর নিয়ে জোর আলোচনা চলছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। মোদীর ওড়াকান্দি সফরের সুফল বিজেপি ভোট ব্যাঙ্কে পাবে কিনা তার চুলচেরা বিশ্লেষণও শুরু হয়েছে। আর এর মাঝেই স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভিসা বাতিলের আবেদন তুলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশি অফিনেতা ফেরদৌসকেও টেনে এনেছেন মমতা। এটা সত্যি উনিশের ভোটে তৃণমূলের হয়ে প্রচার করার জন্য ওপার বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা ফেরদৌস ও নুরকে ভারতীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ভিসা বাতিল করে দেশে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। সেই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করে মুখ্যমন্ত্রী কি আদৌও প্রধানমন্ত্রীর ভিসা বাতিলের দাবি করতে পারেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
কেন বাতিল হয়েছিল ফেরদৌসের ভিসা
উনিশের লোকসভা ভোটে রায়গঞ্জের তৃণমূল প্রার্থীর সমর্থনে প্রচার করতে এসেছিলেন বাংলাদেশের নায়ক ফেরদৌস আহমেদ। রায়গঞ্জের প্রার্থী কানাইয়ালালের হয়ে জোড়াফুলে ভোট চান বাংলাদেশী অভিনেতা। করণদিঘী থেকে ইসলামপুর পর্যন্ত ফেরদৌসের সঙ্গে রোড শো করেন টলিউডি তারকা অঙ্কুশ ও পায়েল সরকার। সেই পায়েল সরকারই এবার বেহালা পূর্বে বিজেপির প্রার্থী।
একজন বিদেশি নাগরিক কীভাবে ভারতে এসে ভোটের প্রচার করতে পারেন, সেই প্রশ্ন তুলে এই ঘটনায় সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ পেশ করেছিল বিজেপি। কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টও পৃথকভাবে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। গেরুয়া শিবির তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করায় ফেরদৌসের বিরুদ্ধে ভারতের ভিসা আইন ভঙ্গ এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভাঙার অভিযোগ করে কমিশনের কাছে। শুধু তাই নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের যে প্রার্থীর পক্ষে ফেরদৌস প্রচার করেছেন সেই কানাইয়ালাল আগরওয়ালের প্রার্থীপদ বাতিল করার আবেদন জানানো হয় বিজেপির পক্ষ থেকে। রায়গঞ্জ সংসদীয় আসনটি বাংলাদেশ সংলগ্ন, ওই কেন্দ্রে অর্ধেকেরও বেশি ভোটার মুসলিম। এরপরেই ফেরদৌস আহমেদকে ভারত ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ফরেনার্স ডিভিশন। উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপারের মাধ্যমে তাঁকে ‘লিভ ইন্ডিয়া মেসেজ’ দেওয়া হয়। ‘বিজনেস ভিসা’ নিয়ে এ দেশে এসে রাজনৈতিক দলের প্রচারে যোগ দেওয়ার জন্যই এই সিদ্ধান্ত বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র। ফেরদৌসকে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ করা হয়েছিল। ভিসার শর্ত মানেননি ফেরদৌস। বিদেশে এসে রাজনৈতিক দলের প্রচারে যোগ দিয়েছেন, যা নজিরবিহীন। তাই ভবিষ্যতে তাঁকে ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর মনোভাব দেখানো হবে বলে জানিয়ে দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র। ভারতে ভোটের সময় ফেরদৌস রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ায় সেই সময়ে অস্বস্তিতে পড়েছিল ঢাকার বিদেশ মন্ত্রকও। এদিকে বিতর্কে জড়িয়ে শেষপর্যন্ত ক্ষমা চান বাংলাদেশি অভিনেতা। লিখিত বিবৃতি জারি করে ফেরদৌস দাবি করেন , আগে থেকে পরিকল্পনা করে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রচারে তিনি যাননি। বরং বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল। তাই আবেগের বশে সহকর্মীদের সঙ্গে প্রচারে অংশ নিয়ে ফেলেন।
ফেরদৌসের মত ফিরতে হয় নুরকেও
জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘রানি রাসমণি’-র অন্যতম প্রধান চরিত্রাভিনেতা ছিলেন বাংলাদেশের অভিনেতা গাজি আবদুন নুর। গত লোকসভা ভোটে তাঁকে নিয়েও তৈরি হয়েছিল বিতর্ক। রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের হয়ে ভোট প্রচারে অংশ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল নুরের বিরুদ্ধেও। এই নিয়ে কমিশনে একটি ভিডিও জমা দিয়েছিল বিজেপি। তাতে দেখা যায় দমদমের তৃণমূল প্রার্থী সৌগত রায়ের রোড শোতে একটি প্রচার গাড়ি থেকে গাজি নুর জনতার উদ্দেশে হাত নাড়ছেন। তাঁর পাশে তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র। বিজেপির অভিযোগ পেয়ে নুরের ভিসার বিষয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে জানা যায়—বেআইনি ভাবে ভারতে রয়েছেন তিনি। তাঁর ভিসার মেয়াদ আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে। ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর এ দেশে থেকে যাওয়াটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
প্রধানমন্ত্রীর ওড়াকান্দি সফর ও মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তি
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে গত শুক্রবার ঢাকায় গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সফরের দ্বিতীয় দিন তিনি মতুয়া ধর্মের প্রবক্তা হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থান ওড়াকান্দি সফর করেন। এরপরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী বিধি ভঙ্গের বিস্ফোরক অভিযোগ তোলেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলাদেশে মতুয়া তীর্থে মোদীর সফরকে নিয়ে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, 'বাংলায় নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভোট পেতে ও প্রভাবিত করতেই এই প্রচেষ্টা।' যদিও তৃণমূল সুপ্রিমো মতুয়া সম্প্রদায়ের নাম নেননি। ওড়াকান্দির ঠাকুরবাড়িতে যখন মতুয়া সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছেন মোদী, তখন খড়গপুরের সভা থেকে মোদীকে আক্রমণ শানান মমতা। নির্বাচনী বিধিভঙ্গ করায় মোদীর ভিসা বাতিল হবে না কেন, সেই প্রশ্নও তোলেন। মমতা প্রশ্ন করেন, ‘‘বাংলায় ভোটের সময় আপনি বাংলাদেশে কেন? আপনি যদি ভোট চলাকালীন বাংলাদেশে একটি বিশেষ শ্রেণির মানুষের জন্য ভোট চাইতে যান, তাহলে আপনার ভিসা-পাসপোর্ট কেন বাতিল হবে না? আমরা নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ করব। কখনও বলছে বাংলাদেশ থেকে মমতা সব অনুপ্রবেশ করিয়েছে, আবার কখনও বাংলাদেশে গিয়ে মার্কেটিং করছে। কে ঠিক আর কে ভুল, তার জবাব চাই। নইলে যতদূর যাওয়ার আমরা যাব।’’এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশি অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদের ভিসা বাতিলের প্রসঙ্গও টেনে এনেছিলেনমমতা। বলেছিলেন, ‘‘ফেরদৌস নামে এক বাংলাদেশি ফিল্মস্টার এসেছিল। ২০১৯ লোকসভায় আমাদের একটা র্যালিতে যোগ দিয়েছিল। বিজেপি ওর ভিসা বাতিল করে দিল। আর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী নোটিফিকেশন হওয়ার পরে বিদেশে গিয়ে ভোট নিয়ে কথা বললেন কী হয়? আপনার জন্য সব ছাড়। আর অন্যদের জন্য নয়।’’ শুধু বাংলাদেশে যাওয়া নয়, আমেরিকার নির্বাচনের আগে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনে ‘হাউডি মোদী’ অনুষ্ঠান নিয়েও তোপ দাগেন মমতা। মমতার অভিযোগের পর এই বিষয়ে মঙ্গলবার কমিশনে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছেন তৃণমূল শিবির।
ফেরদৌস-নুরের মত মোদীর ভিস বাতিল হবে?
প্রতমত ওড়াকান্দি গিয়ে মোদী জানিয়েছেন, বহু বছর ধরে তিনি সেখানে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি নাকি ২০১৫-তে বাংলাদেশ সফরের সময়ও ওড়াকান্দিতে আসতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছে অবশেষে তার পূরণ হয়েছে। কোন সন্দেহ নেই এবারের বঙ্গ ভোটে মতুয়ারা অন্যতম নির্নায়ক শক্তি। এই আবহে মতুয়াদের প্রশংসায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যে পুরোপুরি রাজনৈতিক বার্তাও খুঁজে পেয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মস্থানে দাঁড়িয়ে রাজনীতির কোনও কথা সরাসরি বলেলনি মোদী। অন্যদিকে ২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল ‘বিজনেস ভিসা’ নিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন ফেরদৌস। ভিসার শর্ত অনুযায়ী তিনি সিনেমার শুটিং, বিনোদনের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারতেন। ২০২২ সাল পর্যন্ত ভিসা ছিল তাঁর। কিন্তু ‘বিজনেস ভিসা’ নিয়ে এ দেশে এসে রাজনৈতিক দলের প্রচারে যোগ দিয়ে বিতর্কে জড়ান বাংলাদেশি অভিনেতা। অন্যদিকে নুরের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল। কমিশনের নির্বাচনী বিধিতে অন্য দেশের কোনও নাগরিককে দিয়ে নির্বাচনী প্রচার করানো যাবে না, এ বিষয়ে কোনও স্পষ্ট নির্দেশ নেই। কিন্তু ফেরদৌস ও নুরের ক্ষেত্রে ভিসার নিয়ম লঙ্ঘন করার জন্যই তাঁদের বাংলাদেশে ফিরতে হয়েছিল।