পশ্চিমবঙ্গের একটা গ্রামের নাম নন্দীগ্রাম (Nandigram)। তবে এটা নিতান্তই একটা গ্রাম নয়, বরং মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) রাজনৈতিক উত্থানের কেন্দ্রস্থল। এই নন্দীগ্রামেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের আমলে গুলি চালনার ঘটনা ঘটে। তারপরই নন্দীগ্রামের আন্দোলন থেকে সবচেয়ে বেশি জনসমর্থন পান মমতা বন্দ্য়োপাধ্যায়। এর মধ্য়ে বহু বছর কেটে গিয়েছে। এক সময়ের মমতার বিশ্বস্ত মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) এখন তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে। ফলে আসন্ন্ বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আবারও নন্দীগ্রাম ধরে রাখতে নজর দিচ্ছেন তৃণমূল নেত্রী (TMC)।
সোমবার সপ্তাহের শুরুতেই নিজের জনসমর্থন ধরে রাখতে নন্দীগ্রামে সভা করেন মুখ্যমন্ত্রী। বিজেপির বিরুদ্ধে নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে শুভেন্দু অধিকারীর রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে কি পাল্লা দিতে পারবেন মমতা ? কী হতে পারে তাঁর পাল্টা স্ট্র্য়াটেজি ? বর্তমানে পূর্ব ও পশ্চিম দুটি জেলায় বিভক্ত মেদিনীপুর। পরিসংখ্য়ান বলছে, পূর্ব মেদিনীপুরে ১৬ ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৮টি কেন্দ্র রয়েছে। এখানে নিজের রাজনৈতিক কৌশল সাজাতে প্রথমেই শুভেন্দু অধিকারীর বাবা শিশির অধিকারী ও তাঁর ভাইকে দল থেকে সরিয়ে দেন মমতা। কেন এই পথে হাঁটেন তৃণমূল নেত্রী ? কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন, শুভেন্দুর পর একে একে তাঁরাও তৃণমূল ত্যাগ করবেন। অন্য়দিকে, বিজেপিতে গিয়ে শুভেন্দু এখন চালকের আসনে। তৃণমূলে থাকাকালীন কেবলই সক্রিয় নেতা ছাড়া কিছুই ছিলেন না তিনি। তাই পরিবারের অন্য়দের সরিয়ে রাজনৈতিক যুদ্ধের বিভাজনটা স্পষ্ট করলেন তৃণমূল নেত্রী।
দ্বিতীয়ত,শুভেন্দু নিজস্ব দল না গড়ায় খুশি হয়েছেন মমতা। তৃণমূল নেত্রী ও দলের স্ট্র্য়াটেজিস্ট প্রশান্ত কিশেরের পার্টিগণিত বলছে,শুভেন্দু নতন দল গড়লে বেশি ক্ষতি হত তৃণমূলের। কিন্তু শুভেন্দু সে পথে না হাঁটায় এখন বিজেপির বিরুদ্ধে তৃণমূলের লড়াইটা স্পষ্ট। মমতার মতে,পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ মানুষই মোদী-অমিত শাহের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পছন্দ করেন না। সেখানে শুভেন্দু সেই রাজনীতির অঙ্গ হওয়ায় আদতে সুবিধাই হয়েছে তৃণমূলের।
তৃতীয়ত, শুভেন্দু দলে থাকাকালীন মমতা যাদের গুরুত্ব দেননি, আজ সেই সুফিয়ান , আবু তাহেররাই চালকের আসনে। মমতার সভা অনুষ্ঠিত করতে তাদেরই কাজে লাগাচ্ছে দল। আজ তেখালিতে সভা করেন মুখ্য়মন্ত্রী। এই সেই স্থান যেখানে ১৪ মার্চ গুলি চালিয়েছিল পুলিশ। যার জেরে প্রাণ হারান তিনজন। আসলে নন্দীগ্রাম এখান থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে। এছাড়াও এখানেই রয়েছে চণ্ডীপুরের কাছে আরও একটা সভা করার কথা ছিল মমতার। এই দুই কেন্দ্রেই জয় নিশ্চিত করতে চান মমতা। পরিসংখ্য়ান বলছে, এই দুটি স্থানেই মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন রয়েছেন। তৃণমূল নেত্র্রীর মতে, শুভেন্দু অধিকারী দল ছেডে় বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় তাকে ভোট দেবে না এই ভোটাররা। এমনিতে এই অঞ্চলে বিজেপির কোনও সংগঠন নেই। তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া লোকজনরাই এখানে সংগঠন গড়ার চেষ্টা করছেন। মূল্ত, আগামী ভোটযুদ্ধে মোদী ও শুভেন্দু অধিকারীর ছবি দিয়েই বিধানসভার যুদ্ধে নামবে বিজেপি। সেই জায়গা থেকে বিজেপিকে পাল্টা কাউন্টার করতে নিজের ছবি পোস্টারে ব্য়বহার করছেন মমতা।
কিন্তু এতকিছুর পরও আজ তেখালির সভায় মাস্টারস্ট্রোকটা আসার অপেক্ষা ছিল। যখন নন্দীগ্রাম থেকে বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী। যা রাজনৈতিক মহলে একেবারে আলোড়ন ফেলে দেয়। বর্তমানে শুভেন্দু অধিকারীর কেন্দ্র নন্দীগ্রাম। কিন্তু মমতার হঠাৎ এই আসন থেকে লড়ার ঘোষণা সমস্যায় ফেলবে শুভেন্দুকে। নির্বাচনে লড়ার কথা না বললেও শুভেন্দুকে এইসব অঞ্চলে প্রচারের কাজে লাগাবে বিজেপি। প্রাক্তন দলে থাকাকালীন এইসব অঞ্চলে জনপ্রিয়তা ছিল শুভেন্দুর।
সবথেকে বড় কথা, এখন শুভেন্দুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন মমতা। অতীতে শুভেন্দু বলেছিলেন, মুখ্য়মন্ত্রী নন্দীগ্রামে সভা করলে পাল্টা তিনিও নন্দীগ্রামে সভা করবেন। আসন্ন নির্বাচনে এখন লড়াইটা মমতা বনাম শুভেন্দু হতে চলেছে। এইসব জায়গায় মুসলিম অধ্য়ুষিত অঞ্চলগুলির ভোটাররা কোনওভাবেই বিজেপিকে ভোট দেবে না। শুধু মুসলিমরা নন,তফশিলি ও হিন্দুরাও মমতার দিকে ঝুকে থাকায় বিজেপিকে ভোট দেবে না। এখন দেখার বিষয়, মমতার নির্বাচনী কৌশলকে কীভাবে কাউন্টার করে বিজেপি। আজ নন্দীগ্রাম শুধু একটা গ্রাম নয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একটা প্রতীক। এই নন্দীগ্রাম আন্দোলনের মাধ্য়মেই অতীতে রাজনৈতিক সাফল্যের মুখ দেখেছিলেন মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। যে আন্দোলন সিঙ্গুর থেকে শুরু হয়ে নন্দীগ্রামে শেষ হয়েছিল। সিপিএমের আমলে পুলিশের গুলি চালনার পর নন্দীগ্রামের ঘটনা এখন রাজ্য়ের গল্প হয়ে উঠেছে।
আগামী দিনে ভোট য়ুদ্ধে জিততে এই ধরনের কৌশলই অবলম্বন করবেন মমতা। বিভিন্ন সময়ে নানা সভার আয়োজন করবেন তিনি। শুধু তাই নয়,কৃষক অধ্য়ুষিত এলাকার জন্য় পদযাত্রাও করবেন তিনি। এমনকী কৃষকদের জন্য় বেশকিছু ঘোষণাও রয়েছে তাঁর চিন্তাভাবনায়। বর্তমানে নন্দীগ্রামে বিজেপিকে পায়ের তলায় জমি দিতে রাজি নন তৃণমূল নেত্রী। মমতার সভার পর পাল্টা সভা করার কথা বলেছেন শুভেন্দু অধিকারী। এদিন নন্দীগ্রামে মমতার সভায় আশানুরূপ ভিড় দেখা গেছে। আগামী দিনে এই আসন ধরে রাখতে স্থানীয়দের সঙ্গে জনসংযোগ বাড়ানোয় গুরুত্ব দেবেন তৃণমূল নেত্রী। কারণ মমতা জানেন,এই জনসংযোগই তাঁর আসন জয়ের চাবিকাঠি।