তিনি নিজে ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। তাই রাজ্য সরকার ইমাম-মোয়াজ্জমদের ভাতা দেওয়া চালু করতে তিনি নিজে পুরোহিতদের ভাতার জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে দরবার করেছিলেন। শুক্রবার কামারপুকুরে ব্রাহ্মণদের এক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন রাজ্যের বনমন্ত্রী। সেখানে দাঁড়িয়েই পুরোহিতদের দাবি আদায় করতে প্রয়োজনে মহানগরকে অচল করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যা। মুখে 'যত মত, তত পথ' বুলি। যদিও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের এই বাণীকে তিনি রাজনৈতিক ভাবে বলেননি বলেই দাবি করছেন ডোমজুড়ের বিধায়ক। তবে তাঁর মুখে এই কথা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে শুরু হয়ে গিয়েছে জোর চর্চা।
এমনিতেই শুভেন্দু অধিকারীর অধ্যায় নিয়ে বিব্রত রয়েছে দল। শুভেন্দু এখনও তৃণমূলের সদস্য হলেও কোনও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেই অংশ নিচ্ছেন না। ছেড়ে দিয়েছেন মন্ত্রিত্ব। দলীয় নেতৃত্বকে হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে দিয়েছেন, আর একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব নয়। তৃণমূলে যে শুভেন্দু চ্যাপ্টার শেষ তা প্রায় ধরে নিয়েছেন স্বয়ং নেত্রীও। এরমধ্যেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে দলের মধ্যে ও বাইরে গুঞ্জন ক্রমেই বাড়ছে। শুভেন্দুর মতই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে শহর জুড়ে পোস্টার পড়ছে। শ্য়ামবাজার থেকে গিরিশপার্ক, কাঁকুড়গাছি থেকে উল্টোডাঙা, সব খানেই একটা কথা "কাজের মানুষ-কাছের মানুষ"।
কেবল কলকাতা নয় কয়েকদিন আগেই রাজীবের নামে পোস্টার পড়েছিল হাওড়ার বালিতেও পোস্টার পড়েছিল। বালিখাল, নিমতলায় ওই পোস্টার ব্যানারে লেখা ছিল শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা রাজীবদা ভরসা। এমনকি চলতি সপ্তাহে বুধবার গোপালনগরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভার আগে ঠাকুরনগর, গাইঘাটায় রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে পোস্টার চোখে পড়ে। গত কয়েকদিন ধরে রাজীবের নামে এভাবে একের পর এক পোস্টারে যথেষ্টই বিব্রত তৃণমূল শিবির। এরমধ্যে দলের বিরুদ্ধে আগেই মুখ খুলেছেন রাজীব। প্রকাশ করেছেন নিজের অভিমানের কথাও।
গত শনিবার হরিদেবপুরে একটি অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছিলেন মমতা মন্ত্রীসভার অন্যতম অ্যাকটিভ এই সদস্য। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘যারা দুর্নীতিগ্রস্ত তারা স্তাবক বলে সামনের সারিতে। যখন মানুষ ভাল কাজ করতে আসে, তখন পিছন থেকে টেনে ধরে।’’ জনগণ পছন্দ করে না এমন কিছু মুখ দলের নেতৃত্বে রয়েছে বলেও সেদিন অভিযোগ করেন রাজীব। সেই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যারা ঠান্ডা ঘরে বসে থাকে তারাই এখন নেতৃত্বের সামনের সারিতে।’’
তবে এই প্রথম নয়। আমফান পরবর্তী দুর্নীতি নিয়েও এর আগে সরব হয়েছিলেন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্য়ায়। বলেছিলেন, ‘দলকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে শুধু চুনোপুঁটিকে ধরলেই হবে না, রাঘব বোয়ালদের ধরতে হবে। তা না হলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে।’ এই মন্তব্যের পরই হাওড়ার বিধায়কের ক্ষোভ প্রশমণে সক্রিয় হন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য করা হয় তাঁকে। কিন্তু শনিবার রাজীব ফের বেসুরো বাজতেই তৃণমূলের তরফে প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। ফিরহাদ হাকিম 'ডিপ্রেশন'-এর যুক্তি দিয়েছেন। তবে যাকে নিয়ে রাজীবের সবচেয়ে বেশি সমস্যা সেই অরূপ রায় খোঁচা দিতে ছাড়েননি। দলের অন্দরের খবর, হাওড়া জেলা তৃণমূলের চেয়ারম্যান অরূপ রায়ের সঙ্গে মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধ কারোর অজানা নয়। এতে অরূপ রায়কে দলেই একাংশ মদত যোগাচ্ছে। যা নিয়েই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যেয় ক্ষোভ বাড়ছে। যার বহিঃপ্রকাশ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ‘অসন্তোষ’।
এই মুহূর্তে শুভেন্দু অধিকারীকে ঘিরে তৃণমূলের অন্দরে প্রবল টানাপড়েন চলছে। নেতৃত্বের প্রতি ‘অসন্তোষ’ই শুভেন্দুর সঙ্গে দলের দূরত্ব তৈরি করেছিল। যেভাবে রাজীবের নামে রাজ্যজুড়ে পোস্টার পড়ছে তাতে অনেকেই বলাবলি শুরু করে দিয়েছেন, শুভেন্দুর পথে হাঁটতে পারেন তিনিও। যদিও রাজীব বলছেন, এখনও পর্যন্ত তিনি দলেরই একজন কর্মী। মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। "আমি এখনো দলের মধ্যে থেকেই কথা বলছি। স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব কথা সব জায়গায় বলাই যায়। এর মধ্যে অপরাধের তো কিছু নেই।"
তবে দলের অন্দরে স্তাবকথা নিয়ে এখনও যে তিনি নিজের অবস্থানে অনড় সেকথাও কামারপুকুরের অরাজনৈতিক অনুষ্ঠানে বুঝিয়ে দিয়েছেন রাজীব। গত সপ্তাহের বক্তব্য নিয়ে রাজীবের ব্যাখ্যা, 'আমি তো নিজে বলেছি সেই কথা, অস্বীকার করতে পারি না, প্রকাশ্যেই বলেছি।' এদিকে রাজীবের এই ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যে চওড়া হচ্ছে গেরুয়া শিবিরের হাসি। বিজেপি নেতা মুকুল রায় ইতিমধ্যে বনমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে প্রতিক্রিয়াও দিয়েছেন। মুকুলের কথায়, "ও অনেক দিন ধরেই অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলছে। ওগুলোর অনেক ব্যাখ্যা হয়। " এর আগে রাজীব বলেছিলেন, ‘‘শুভেন্দু চলে গেলে বিশাল শূন্যতা তৈরি হবে।’’ তবে গত কয়েকদিনে তাঁকে নিয়ে যেভাবে জল্পনা বাড়ছে রাজ্য রাজনীতিতে তাতে শুভেন্দুর সঙ্গে রাজীবও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে কোনও চমক দেন কিনা সেদিকেই তাকিয়ে বঙ্গ রাজনীতি।