অবশেষে বঙ্গ ভোটের দিন ঘোষণা করে দিল নির্বাচন কমিশন। মানে আগামী কয়েকদিন রাজ্য রাজনীতিতে প্রচারের ঝড় উঠবে। বিহার নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাকে ফোকাস করে এগোচ্ছে গেরুয়া শিবির। বঙ্গে ক্ষমতা দখল করতে নিয়মিত সফরে আসছেন অমিত শাহ- জেপি নাড্ডারা। ভোটের দিন ঘোষণার পর এবার মোদীকেও দেখা যাবে নিয়মিত সভা করতে। এবারের বিধানসভা ভোটে বাঙালি মন পেতে একের পর এক মনীষীর স্মরণ নিচ্ছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বাঙালি আবেগ উস্কে দিতে প্রধানমন্ত্রীর মুখে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বা সুভাষচন্দ্রের উদ্ধৃতি। পিছিয়ে নেই বিজেপির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতারাও। বঙ্গসফরে এসে বিবেকানন্দের বাড়ি থেকে ক্ষুদিরামের মাসির বাড়, সবখানেই দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন অমিত শাহ। সেই ধারা বজায় রেখে বৃহস্পতিবার বাংলায় এসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি দর্শনে গেলেন নাড্ডা। নাড্ডার সফরের দু'দিন আগেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখেও শোনা গিয়েছিল সাহিত্য সম্রাটের নাম। বিধানসভা ভোটে বাঙালি আবেগ টানতে সুচারু ভাবেই এবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে নিজেদের স্ট্র্যাটেজিতে ব্যবহার করতে চাইছে গেরুয়া শিবির, এমনটাই মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
মোদীর বঙ্কিম বন্দনা
গত সোমবার কয়েকঘণ্টার জন্য বাংলায় এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বাংলায় মমতা সরকারের অপশাসন নিয়ে সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বাঙালি মনীষীদের নাম নিতে দেখা যায় মোদীকে। তবে প্রধানমন্ত্রীর মুখে বিশেষ ভাবে শোনা যায় সাহিত্য সম্রাটের কথা। তাঁর দাবি ছিল বঙ্কিম চন্দ্রের স্মৃতি বিজড়িত 'বন্দে মাতরম' ভবনকে সেভাবে দেখভাল করছেনা মমতা সরকার। হুগলির ডানলপের সভায় দাঁড়িয়ে মোদী বলেন, তিনি শুনেছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বন্দেমাতরম ভবনে ৫ বছর ছিলেন। সেই ভবনের অবস্থা খুবই খারাপ। মোদী বলেন, 'সেই বন্দে মাতরম , যা স্বাধীনতার লড়াইতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছিল '। তাঁর অভিযোগ যে সেই ভবন আজ তৃণমূলের শাসনে উপেক্ষিত।
এবার বঙ্কিমের ভিটেতে হাজির নাড্ডা
মোদীর বঙ্কিম স্মরণের তিন দিনের মধ্যেই এবার সাহিত্য সম্রাটের বাড়িতে হাজির হলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। বৃহস্পতিবার দুপুরে নৈহাটির কাঁঠালপাড়ায় বন্দেমাতরমের স্রষ্টা, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্মস্থান ঘুরে দেখেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। আধ ঘণ্টার সফরে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মভিটে, অডিটোরিয়াম, লাইব্রেরি, জন্মস্থান, শয়নকক্ষ সব খানে জান। বঙ্কিম সংগ্রহশালাও ঘুরে দেখেন নাড্ডা। তবে বঙ্কিম ভবনের অবস্থা দেখে মোদীর মত সমালোচনা করতে দেখা যায়নি নাড্ডাকে। বরং, বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মভিটে এবং সংগ্রহশালা যেমন সুন্দর ভাবে পরিপাটি অবস্থায় সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে, তাতে তিনি খুশিই হয়েছেন। বিজেপির দুই শীর্ষ নেতার এই পৃথক অবস্থান নিয়ে অবশ্য কটাক্ষ করতে ছাড়েনি রাজ্যের শাসক দল। বঙ্কিম ভবনে দাঁড়িয়ে নাড্ডা বলেন, ' বঙ্কিমচন্দ্র দেশের জন্য যা করেছেন তার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রণাম জানাই, তিনি বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ভারতকে গৌরবান্বিত করেছেন ।' বন্দেমাতরমের প্রশংসায় পঞ্চমুখ নাড্ডা বলেন, 'দেশের গর্ব বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।' তিনি যেখানে বসে বন্দেমাতরম রচনা করেছেন, সেই পবিত্র স্থান দেখার সৌভাগ্য মিলেছে।' এরপরেই ফের মমতার সরকারকে তোপ দেগে বলেন,' বাংলার মনীষিদের নিয়েও রাজনীতি হচ্ছে।'
ভোট ময়দানে বিজেপির নজরে কেন বঙ্কিম?
রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক, কোন অনুষ্ঠান হলেই প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে এখন শোনা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও গান। বাংলা বলার চেষ্টা করছেন নরেন্দ্র মোদী। নেতাজির জন্মজয়ন্তীতে চলে এসেছেন কলকাতায়। বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ. চৈতন্য-সহ বাংলার সমস্ত সমাজ সংস্কারকের কথাই আসছে মোদীর গলায়।বাদ যাচ্ছেন না ক্ষুদিরাম বসু থেকে অরবিন্দ ঘোষ, রাসবিহারী বসুদের মত বিপ্লবীরাও। সম্প্রতি কলকাতায় এসে স্বাধীনতা সংগ্রামে শহিদ হওয়া বিস্মৃত বাঙালি বিপ্লবীদের স্মরণ করতে দেখা যায় অমিত শাহকে। সুভাষচন্দ্র বসুর কাজ ও আদর্শকে ভুলিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে এমন বিস্ফোরক অভিযোগ করতেও শোনা যায় শাহকে। ভোটমুখী বাংলার মন পেতে বাংলার বীর সন্তানরা যেন মোদী-শাহদের এবারের 'ট্রাম্পকার্ড'। বিজেপি নেতাদের এই মনীষী প্রীতির মাঝেই আলাদা করে নজর কেড়েছেন সাহিত্য সম্রাট। এর পিছনে বিজেপির জাতীয়তাবাদের নীতিই মুখ্য কারণ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত৷ ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য৷ অনেকে বঙ্কিমচন্দ্রকে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদী’র জনকও বলে থাকেন। কিন্তু বঙ্কিমের জাতীয়তাবাদ কখনই হিন্দু-মুসলমানকে আলাদা করে দেখা নয়৷ তাই রাজ্যে বিজেপি নরম হিন্দুত্ব-র পাশাপাশি মুসলমানদেরও কাছে টানতে চেয়েছে৷ বঙ্কিমচন্দ্র, আনন্দমঠ এবং বন্দেমাতরম এই তিনটি শব্দ প্রায় ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সমার্থক। বাঙালি–মন পেতে মরিয়া বিজেপি তাই এবার বঙ্গ জয়ে ‘বন্দেমাতরম’-এর স্রষ্টাকেই পাথেয় করতে চাইছে কি?