তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কথা বঙ্গ রাজনীতিতে এখন আর কারও অজানা নয়। গোষ্ঠী কোন্দলে জেরবার স্বয়ং দলনেত্রী। তারজেরেই দলত্যাগের হিড়িক বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তৃণমূল থেকে দলত্যাগিদের বেশিরভাগ অংশটাই আসছে গেরুয়া শিবিরে। নতুন কর্মীদের আগমনে বাংলায় বিজেপির যেমন শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে তেমনি নতুন রোগও দানা বাঁধছে শরীরে। তৃণমূলের মত গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার হচ্ছে গেরুয়া শিবিরও। আর ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই বিজেপির অন্দরে আদি-নব্য দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসছে। বিজেপির মত সংগঠতিক দলে স্বাভাবিকভাবেই তাতে অস্বস্তি বাড়ছে। ভোটের আগে নীল বাড়ি দখলের অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এই অন্তর্দ্বন্দ্ব।
২০১৭ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন মুকুল রায়। তারপর থেকেই শাসক দল থেকে গেরুয়া শিবিরে যোগদানের হিড়িক চলছে। গত লোকসভা ভোটের আগে যেমন চমক দিয়েছিল বিজেপি, তেমনি এবারের বিধানসভা ভোটের আগেও সেই ধারা অব্যাহত। সম্প্রতি দলে শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতারা যোগ দিয়েছেন। এতে দলের গ্ল্যামার বেড়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কিছু প্রশ্নও দানাও বাঁধছে। বিশেষ করে জেলায় জেলায় যেভাবে গোষ্ঠী সংঘর্ষ প্রকাশ্যে আসছে তাতে আগামী দিনে বড় কোনও ঝড় আসতে পারে তা ভালই অনুমান করতে পারছেন অমিত শাহ-জেপি নাড্ডারা।
জেলায় জেলায় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব
ধিকিধিকি আগুন জ্বলছিল গতবছর লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকেই। হাইকমান্ডের নির্দেশে গতবছর তৃণমূল থেকে আসা নেতাদের বড় পদপ্রাপ্তিতে তাতে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল। বিজেপির অন্দরে কান পাতলেই এখন আদি বিজেপি কর্মীদের একটাই সুর শোনা যায়। তাঁদের ক্ষোভ, যাঁরা এতদিন রাস্তায় নেমে ঝান্ডা হাতে দল করছিলেন তাঁরাই এখন ব্রাত্য। অন্য দলের ছাঁটাই নেতারা এখন দল চালাচ্ছেন। মালদহ থেকে বাঁকুড়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা, পুরুলিয়া সবখানেই একচিত্র। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে আসা নেতাদের নামে পড়ছে পোস্টার। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে যাওয়া উত্তরপাড়ার বিধায়ক প্রবীর ঘোষাল। গত শনিবার দিল্লি গিয়ে অমিত শাহের হাত থেকে গেরুয়া পতাকা নেন প্রবীরবাবু। আর গতকাল তাঁর বিরুদ্ধে ফেসবুকে একাধিক অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন এলাকার বিজেপি কর্মীদের একাংশ। প্রবীরবাবুকে শিশু পাচারকারী আখ্যাও দিয়েছেন তাঁরা। নিচুতলার কমীদের এই আচরণে স্বাভাবিক ভাবেই অস্বস্তি বাড়ছে গেরুয়া শিবিরের। নিচুতলার রাগ প্রকাশ্যে চলে এসেছে যেমন, তেমনি উপরতলাতেও কিন্তু জমছে ক্ষোভ। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল কয়েকমাস আগে রাহুল সিনহার কথাতেই।
বিস্ফোরক রাহুল
গতবছর সেপ্টেম্বরে মুকুল রায় বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতির পদ পেতেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বঙ্গ বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য় সভাপতি রাহুল সিনহা। সেটাই ছিল বাংলার বিজেপিতে বিদ্রোহের প্রথম প্রকাশ্যে আসা আগুন। কেন্দ্রীয় সম্পাদক পদ থেকে রাহুলকে সরাতেই নিজের ফেসবুক পেজে ভিডিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। এদিকে সেপ্টেম্বরেই তৃণমূল থেকে আসা আরেক নেতা অনুপম হাজরাকে কেন্দ্রীয় সম্পাদক করা হয়। দলের এই সিদ্ধান্তে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন রাহুল সিনহা। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি সেই সময় বলেছিলেন, “৪০ বছর বিজেপির সেবা ও বিজেপির একজন সৈনিক হিসাবে কাজ করে এসেছি। জন্মলগ্ন থেকে বিজেপির সেবা করবার এটাই পুরস্কার পেলাম যে, তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা আসছে তাই আমাকে সরতে হবে। এর চেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হতে পারে না। এবার আমার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা আমি ঠিক করব।” রাহুল সিনহার এই বিস্ফোরণের পর মনে করা হচ্ছিল মুকুল শিবির বঙ্গ বিজেপিতে ধীরে ধীরে আধিপত্য কায়েম করায় ক্ষোভ চেপে রাখতে পারেননি দীর্ঘদিনের দলীয় সৈনিক। তিনি দল ছাড়তে পারেন এমন গুঞ্জনও শোনা যাচ্ছিল। সেই সময় রাহুলের মানভঞ্জন করতে ময়দানে নেমেছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। কোনওমতে সামাল দেওয়া গিয়েছিল পরিস্থিতি।
দিলীপ-মুকুল ঠাণ্ডা লড়ই?
২০১৭ সালে তৃণমূল ছেড়ে গেরুয়া শিবিরে গিয়েছিলেন মুকুল রায়। তারও আগে থেকে রাজ্য গেরুয়া শিবির সামলাচ্ছেন রাহুল সিনহা, দিলীপ ঘোষরা। কিন্তু মুকুল রায় বিজেপিতে যাওয়ার পর থেকেই দিলীপ-রাহুলের প্রভাব প্রতিপত্তি কমে আসে। অনেক সময়ই মুকুলের সঙ্গে দিলীপ ঘোষের বিবাদ প্রকাশ্যে আসতে দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে গতবছর দুর্গাপুজোর আয়োজন নিয়ে। দিলীপের বক্তব্য ছিল, কোনও রাজনৈতিক দল পুজো করে না। কিন্তু মুকুল রায়ের দাবি ছিল, বিজেপি দুর্গাপুজোর আয়োজন করবে। একাধিকবার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুই নেতাকে একসঙ্গে নিয়ে বসেছেন। একসঙ্গে চলার নির্দেশও দিয়েছেন। কিন্তু বরফ গেলেনি। চাপা টেনশনটা রয়েছে। তবে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিয়ে কোনও পক্ষই সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। অসুস্থ মুকুলকে দেখতে যেমন হাসপাতালে যেতে দেখা গেছে দিলীপক। তেমনি মুকুল স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বঙ্গ বিজেপিতে মুকুল-দিলীপ দ্বন্দ্ব জল্পনা ভিত্তিহীন। তাঁর সঙ্গে বাংলার বিজেপি সভাপতির কোনও বিরোধ নেই।
শুভেন্দু-দিলীপ সম্পর্কের শীতলতা
বঙ্গ বিজেপি-র অন্দরেই কান পাতলে শোনা যায়, মঞ্চে গলায়-গলায় ভাব দেখালেও দিলীপ ঘোষ-শুভেন্দু অধিকারীর সম্পর্কে একটা ‘শৈত্য’ রয়েছে। গত ১৯ ডিসেম্বর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন শুভেন্দু। গেরুয়া শিবিরে নাম লেখানোর পর থেকেই দলে আলাদা গুরুত্ব পাচ্ছেন তিনি। তাতে কিছুটা হলেও কোণঠাসা বিজেপির রাজ্য সভাপতি। যদিও প্রথম থেকেই একসাথে কাজ করার কথা বলছেন শুভেন্দু। প্রতিটি সভাতে শুভেন্দু অধিকারী দিলীপ ঘোষের ভূয়সী প্রশংসাও করছেন। তবে মুখে যাই বলুন, বাস্তবের চিত্রটা অনেকটাই আলাদা তা ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। কয়েকদিন আগে হাওড়ায় দিলীপ ঘোষের অনুষ্ঠানে আসার কথা থাকলেও সেখানে দেখা যায়নি শুভেন্দুকে। তিনি দলে নতুন এলেও তাঁর গুরুত্ব যে নেহাত কম নয় তা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। ওই অনুষ্ঠানে থাকার কথা ছিল মুকুলেরও। মুকুল রায় দিলীপ ঘোষ আসার আগেই চলে গিয়েছিলেন। শুভেন্দু অধিকারী যথেষ্ট গুরুত্ব পাওয়ার কারণে দিলীপ এবং তার অনুগামীরাা যে কিছুটা ক্ষুব্ধ সে ব্যাপারে নিশ্চিত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। ফলে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে যে দিলীপের একটা ঠান্ডা লড়াই তৈরি হচ্ছে তা যোগদানের পরের সভা থেকেই সহজে অনুমান করা যাচ্ছে।
আসন নিয়ে বাড়ছে জটিলত
গত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এরাজ্যে ১২১ টি বিধানসভা আসনে বিজেপি এগিয়ে। লোকসভায় ১৮ আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি। তার সেই জয়ের পর যারা বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তাদেরকে ‘নব্য’ বলেই ধরছে রাজ্য বিজেপির ‘আদি’–দের একাংশ। আর তাঁরাই আওয়াজ তুলছেন, গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা নেতাদেরই এগিয়ে থাকা ১২১ টি আসনে প্রার্থী করা হোক। যাঁরা পরে এসেছেন এবং এর পরেও আসবেন, তাঁরা লড়ুন বাকি ১৭৩ আসনে। এবং জিতে দেখান! ওই ‘আদি’ নেতাদের বক্তব্য, যে সব এলাকায় বিজেপি একাই জেতার মতো জায়গায় রয়েছে, সেখানে দলের নীতি আলাদা হোক। অনেক ক্ষেত্রে এমনও বলা হচ্ছে যে, তৃণমূল থেকে এমন অনেক নেতা বিজেপি–তে এসেছেন বা আসতে পারেন, যাঁদের সঙ্গে দলের কর্মীদের লড়তে হয়েছিল লোকসভা নির্বাচনে।
বাংলার বিজেপি এখন তিন ধারায় বইছে। তাই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে অনেক ক্ষেত্রেই। ক্ষমতায় আসার আগেই গোষ্ঠীকোন্দল এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছে, যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে বঞ্চনার অভিযোগ করেছেন পুরনো নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, যখন কেউ ছিল না, তখন তাঁরা ছিলেন। অথচ আজ তাঁরাই বাদ!
ক্ষমতা নিজের হাতেই রাখছেন শাহ
রাজ্য সফরে এসে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার বার্তা বারবার দিচ্ছেন অমিত শাহ। কিন্তু তিনি দিল্লিতে ফিরতেই বঙ্গ বিজেপিতে গোষ্ঠী কোন্দলের খবর আসছে। প্রায়শই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। মুকুল রায় যত পুরনো তৃণমূলীদের ভাঙিয়ে আনছেন, ততই বিজেপিতে আদি-নব্য দ্বন্দ্ব বাড়ছে। বিজেপিতে এবার তিন নেতার পছন্দের প্রার্থী নিয়ে অমিত শাহকে বেগ পেতে হবে। এমনিতেই বঙ্গ বিজেপিতে মুকুল রায় বনাম দিলীপ ঘোষের একটা লড়াই রয়েছে। ভোটের আগে শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামীদের দাবিও এবার জোরদার হবে। শোনা যাচ্ছে এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন অমিত শাহ নিজেই। সেইসঙ্গে শাহ বুঝিয়ে দিয়েছেন, বাংলার ক্ষমতা দখলই বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য। তাই একসঙ্গে চলতে হবে। গোষ্ঠীকোন্দল শিকেয় তুলে রাখতে হবে। বিজেপিতে যোগ দেওয়া নবাগতদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।
বন্ধ হল যোগদান মেলা
গত একমাস ধরে বিভিন্ন জেলায় যোগদান মেলা করেছে বিজেপি। তৃণমূলের কোমর ভেঙে গেরুয়া শিবিরে নাম লিখিয়েছেন শুভেন্দু, রাজীবের মত নেতারা। তবে বিধানসভা ভোটের আগে আর কাউকে বিজেপিতে যোগদান করানো হবে না, এমনই সিদ্ধান্ত নিল গেরুয়া শিবির। কিছুদিন আগে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আভাস দিয়েছিলেন, এবার তাঁরা দরজা ছোট করে ফেলবেন। এবার বঙ্গ বিজেপির পর্যবেক্ষক কৈলাশ বিজয়বর্গীয় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিলেন, ভোটের মুখে বিজেপিতে যোগদানের দরজা বন্ধ। বিজয়বর্গীয় স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, ভোট শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য দল থেকে আর কাউকেই দলে নেওয়া হবে না। ভোট ফুরালে আবার বিজেপি তাদের দরজা খুলবে। গোষ্ঠী কোন্দল সামলাতেই কি সুচারু কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এমন সিদ্ধান্ত নিল কিনা সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।