অনেক সময় মাছ ধরতে গিয়ে পথ হারিয়ে অন্য দেশের জলসীমায় ঢুকে পড়ে বিভিন্ন দেশের জেলেদের ট্রলার। অবৈধভাবে জলসীমা অতিক্রম করার জন্য ট্রলার-সহ সেই দেশের নৌবাহিনীর হাতে আটক হতে হয় এইসব জেলেদের। এমনকি সাজা হিসাবে তাদেরকে জেলেও থাকতে হয়।
এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে অবৈধভাবে আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করায় জেলেদের ট্রলার আটক করার একটি ভিডিও। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, নিজেদের দুটি ট্রলারের সাহায্যে অন্য একটি ট্রলারকে ধাওয়া করে আটক করছে নৌবাহিনীর জওয়ানরা। ভিডিওটি শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে, ভারতীয় জেলেদের ট্রলার অবৈধভাবে বাংলাদেশের জলসীমায় মাছ ধরতে ঢুকে পড়ে। তখন তাদেরকে আটক করে বাংলাদেশের নৌবাহিনী।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন, “ইন্ডিয়ার টলার যখন বাংলাদেশে মাছ ধরতে আসে। তখন বাংলাদেশ নৌবাহিনী এন্ট্রি।” (সব বানান অপরিবর্তিত।) অর্থাৎ ক্যাপশনের মাধ্যমে এটাই বোঝানো হচ্ছে, যে ট্রলারটিকে আটক বা ধাওয়া করা হচ্ছে সেটি ভারতের জেলেদের। পাশাপাশি সেটিকে যারা আটক করছে তারা হল বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল ভিডিওতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতীয় জেলেদের ট্রলার আটক করেনি। বরং সেটিতে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীকে ভিয়েতনামের জেলেদের ট্রলার আটক করতে দেখা যাচ্ছে।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
ভাইরাল ভিডিওটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার সময় আমরা সেটির ৫৪ সেকেন্ডে নৌবাহিনীর একজন জওয়ানের পোশাকের পিছনে ‘Kapal Pengawas’ লেখাটি দেখতে পাই। পাশাপাশি তার পোশাকের হাতায় লাল-সাদা রঙের একটি পতাকাও আমাদের নজরে আসে। পরবর্তীতে আমরা ‘Kapal Pengawas’ শব্দ দুটি নিয়েগুগুলে সার্চ করলে জানতে পারি সেটি ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লেখা। যার অর্থ ‘নজরদারি জাহাজ’। এর থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে ভাইরাল ভিডিওতে নৌবাহিনীর যে জওয়ানদের দেখা যাচ্ছে তারা ইন্দোনেশিয়ান হলেও হতে পারে।
এরপর আমরা সেই সূত্র ধরে গুগুলে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পতাকা খুঁজে বার করি। সেখানে আমরা দেখি ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় পতাকাটি উপরে লাল ও নিচে সাদা এই দুই রঙ দিয়ে তৈরি এবং পতাকাটি আয়তাকার। এরপর সেই পতাকার সঙ্গে আমরা ভাইরাল ভিডিওতে ওই জওয়ানের পোশাকের হাতায় থাকা লাল-সাদা রঙের পতাকাটিকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করি। তখন আমরা উভয়ের মধ্যে হুবহু মিল খুঁজে পাই। এর থেকে এক প্রকার নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভাইরাল ভিডিওতে নৌবাহিনীর যে জওয়ানদের দেখা যাচ্ছে তারা ইন্দোনেশিয়ান।
তবে এবিষয়ে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত হতে এবং ভাইরাল ভিডিওটির আসল রহস্য জানতে আমরা সেটি থেকে একাধিক স্ক্রিনশট নিয়ে সেগুলির রিভার্স ইমেজ সার্চ করি। তখন আমরা ২০২০ সালের ২৪ জুলাই আমেরিকান সরকার-অনুদানপ্রাপ্ত অলাভজনক সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার অনলাইন সংস্করণ Benar News-এর অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে এই একই ভিডিও খুঁজে পাই। ভিডিওটি পোস্ট করে সেখানে ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় লেখা হয়েছে, অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় ভিয়েতনামের মাছ ধরার ট্রলার ঢুকে পড়ায় সেটি আটক করেছে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনী।
এরপর পরবর্তী সার্চে আমরা রেডিও ফ্রি এশিয়ার ভিয়েতনামি চ্যানেল ‘RFA Tiếng Việt’-এর অফিশিয়াল ইউটিউব চ্যানেলেও এই একই ভিডিও দেখতে পাই। ভিডিওটি শেয়ার করে এর বিস্তারিত অংশে ভিয়েতনামি ভাষায় লেখা হয়েছে, “২০২০ সালের ২২ জুলাই অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় ঢুকে পড়ায় দুটি ভিয়েতনামি মাছ ধরার ট্রলার-সহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনী। ইন্দোনেশিয়ার সামুদ্রিক বিষয়ক ও মৎস্য মন্ত্রণালয় ভিডিওটি প্রকাশ করে এই তথ্য জানিয়েছে।”
এরপর আমরা ২০২০ সালের ৩০ জুলাই Danviet নামক একটি ভিয়েতনামি সংবাদমাধ্যমে ভাইরাল ভিডিওর ফ্রেমের স্ক্রিনশট-সহ ভিয়েতনামি ভাষায় একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানেও এই একই তথ্য উল্লেখ করে লেখা হয়েছে, অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় ঢুকে পড়ায় ইন্দোনেশিয়ার মেরিটাইম ফোর্স দুটি ভিয়েতনামি মাছ ধরার ট্রলার-সহ মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রেপ্তার করার মুহূর্তে ট্রলারে ৫০ টন মাছ ছিল।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতীয় জেলেদের ট্রলার আটক করেছে দাবি করে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীর ভিডিও ভাইরাল করা হচ্ছে।
অবৈধভাবে জলসীমা অতিক্রম করায় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে আটক ভারতীয় জেলেদের ট্রলার।
ভাইরাল ভিডিওতে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ভারতীয় জেলেদের ট্রলার আটক করেনি। বরং সেটিতে ইন্দোনেশিয়ান নৌবাহিনীকে ভিয়েতনামের জেলেদের ট্রলার আটক করতে দেখা যাচ্ছে।