প্রায়ই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকাশ্য হিজাব আথবা বোরখার পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ার খবর সামনে আসে। সাম্প্রতিককালে ভারতের কর্ণাটক বা মুম্বাইয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক কম হয়নি।
আর এই সবের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় হিজাবের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি সংক্রান্ত একটি পোস্ট বেশ ভাইরাল হয়েছে। সেখানে দাবি করা হচ্ছে, আজ অর্থাৎ ২৬ জুলাই থেকে শুরু হতে চলা ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, এক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই সংক্রান্ত একটি ফটোকার্ড শেয়ার করেছেন। যেখানে লেখা হয়েছে, “২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক এ নিষিদ্ধ হলো হিজাব।” অপর এক ফেসবুক ব্যবহারকারী এই একই দাবি-সহ নিজের ওয়ালে লিখেছেন, “২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক এ নিষিদ্ধ হলো হিজাব। জয় শ্রী রাম।” (ফটোকার্ড ও ক্যাপশনের সব বানান অপরিবর্তিত।) একই দাবি-সহ আরও পোস্ট দেখতে এখানে ক্লিক করুন। এমনই একটি পোস্টের আর্কাইভ এখানে দেখা যাবে।
ইন্ডিয়া টুডে ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে, ভাইরাল দাবিটি অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর। অলিম্পিক্স কমিটি মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। বরং ‘প্যারিস অলিম্পিক্স-২০২৪’এর আয়োজক দেশ ফ্রান্স কেবলমাত্র তাদের দেশের ক্রীড়াবিদ উপরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
কীভাবে জানা গেল সত্য?
অলিম্পিক্স বিশ্বের সব থেকে বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। আর সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকল মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি হলে সেই সংক্রান্ত খবর অবশ্যই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হত। কিন্তু আমরা আমাদের কিওয়ার্ড সার্চে এমন কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য বা প্রতিবেদন পাইনি যা থেকে প্রমাণ হয় অলিম্পিক্স কমিটি ‘প্যারিস অলিম্পিক্স-২০২৪’এ সকল দেশের মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
তবে এই সংক্রান্ত কিওয়ার্ড সার্চ করার সময় আমরা ২০২৪ সালের ১৫ জুলাই আল জাজারিতে একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “প্যারিস অলিম্পিক্স-২০২৪’এর আয়োজক দেশ ফ্রান্স এবারের অলিম্পিক্সে তাদের দেশের ক্রীড়াবিদদে হিজাব পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের তৎকালীন ক্রীড়া মন্ত্রী অ্যামেলি ওউদিয়া-কাস্তেরা এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তিনি জানান, সরকারের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বজায় রাখতে দেশের মহিলা ক্রীড়াবিদদের অলিম্পিক্সের সময় হিজাব পরার অনুমতি দেওয়া হবে না। তবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি নিশ্চিত করেছে যে তাদের তরফে হিজাব বা অন্য কোনও ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পোশাক পরার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।"
এরপর আমরা ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই টাইম ম্যাগাজিনে ফ্রান্সের ক্রীড়াবিদদে হিজাব পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই। সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে, “গত সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রান্সের তৎকালীন ক্রীড়া মন্ত্রী অ্যামেলি ওউদিয়া-কাস্তেরা এবারের অলিম্পিক্সে তাদের দেশের ক্রীড়াবিদদে হিজাব পরার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। তবে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক্স কমিটি এটিকে ফ্রান্সের নিজস্ব ব্যান হিসাবে উল্লেখ করেছে। পাশাপাশি জানিয়েছে অন্য কোনও দেশের ক্রীড়াবিদ হিজাব পরে অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্বাধীন।”
এরপর আমরা ২০২৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ফ্রান্স-২৪-এ এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, “২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে নিজের দেশের মুসলিম ক্রীড়াবিদদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা সংক্রান্ত ফ্রান্সের নির্দেশিকাকে বিরোধীতা করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের অধিকার অফিসের মুখপাত্র মার্তা হুর্তাদো জেনেভায় সাংবাদিকদের বলেন, "কোনও মহিলা কী পরতে পারবেন, আর কী পরতে পারবেন না তা কারোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।"
এরপর আমরা গত ২৫ জুলাই এই সংক্রান্ত দ্য গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাই। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে মুসলিম ক্রীড়াবিদদের হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা সংক্রান্ত ফ্রান্সের নিষেধাজ্ঞাটি কেবলমাত্র নিজের দেশের ক্রীড়াবিদদের উপরে প্রযোজ্য। অন্য কোনও দেশের ক্রীড়াবিদদের উপরে এই নির্দেশিকা প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ তাঁরা চাইলে হিজাব পরে প্যারিস অলিম্পিক্সে অংশ নিতে পারেন।
এর থেকে প্রমাণ হয় যে ২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে হিজাব নিষিদ্ধ হওয়া সংক্রান্ত ভাইরাল পোস্টটি অর্ধসত্য ও বিভ্রান্তিকর।
২০২৪ সালের প্যারিস অলিম্পিক্সে মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
অলিম্পিক্স কমিটি মহিলা ক্রীড়াবিদের হিজাব পরার উপরে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। কেবলমাত্র ফ্রান্স তাদের দেশের ক্রীড়াবিদদের উপরে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এটি অন্য কোনও দেশের ক্রীড়াবিদের উপরে প্রযোজ্য নয়।