ভারত-বাংলাদেশের মাঝে চলতে থাকা টালমাটাল পরিস্থিতির মধ্যে একটি সাদা-কালো পুরনো দিনের ছবি বেশ ভাইরাল হয়েছে। এই ছবিতে সেনার উর্দিতে থাকা এক ব্যক্তিকে দেখা যাচ্ছে অপর এক ব্যক্তির পরনে থাকা লুঙ্গি আলগা করে তার ভিতরে উঁকি মারতে। ছবিটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দাবি করা হচ্ছে যে একাত্তর সালে এভাবেই হিন্দুদের চিহ্নিত করে হত্যা করা হয়েছিল।
ছবিটি শেয়ার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "1971 সালে এই ভাবেই চেক করে হিন্দুদের মারা হয়েছিলো ।। ইতিহাস ভুললে সেই জাতির ধ্বংস অনিবার্য ।" অনেকেই একই ধরনের দাবি করে ছবিটি পোস্ট করেছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার আগে তা ছিল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত। যা পরিচিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান হিসাবে। অর্থাৎ, এই ছবির মাধ্যমে বলতে চাওয়া হয়েছে যে পাকিস্তানি সেনা এই পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ধর্ম বা সম্প্রদায় যাচাই করেছিল এবং এরপর অহিন্দু ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়েছিল।
আজতক ফ্যাক্ট চেক অনুসন্ধান করে দেখেছে যে এই ছবিটির সঙ্গে ধর্ম বা সম্প্রদায় যাচাইয়ের কোনও সম্পর্ক নেই। এই ছবিতে এক ভারতীয় সেনাকে দেখা যাচ্ছে যিনি পরীক্ষা করছিলেন লুঙ্গির আড়ালে লুকিয়ে কোনও অস্ত্র আনা হচ্ছে কি না।
কীভাবে জানা গেল সত্যি
ভাইরাল ছবিটিকে গুগল লেন্সের মাধ্যমে খোঁজা হলে ওই একই ছবি আমরা দেখতে পাই Bangladesh Old Photo Archive নামের একটি ফেসবুক পেজে। ২০১৬ সালের ২ মার্চের এই পোস্টে যা লেখা হয়েছিল তার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, "পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় একজন ভারতীয় সেনা সদস্য সন্দেহভাজন পাকিস্তানি গুপ্তচরের সন্ধান করছে এবং লুঙ্গির মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। বাংলাদেশ (1971)। ফটোগ্রাফার-কিশোর পারেখ।"
এই পোস্টের তথ্যসূত্র হিসেবে যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক নয়নিকা মুখার্জীর একটি সংক্ষিপ্ত গবেষণাপত্রের লিঙ্ক দেওয়া ছিল। সঙ্গে লেখা হয়, "এটাই ছবির সঠিক ক্যাপশন। ছবির প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেকদিন ধরেই একটা ভুল ধারণা প্রচলিত ছিল। সম্প্রতি ডক্টর নয়নিকা মুখার্জী প্রয়াত ফটোগ্রাফার কিশোর পারেখের ছেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবং তার জার্নালে সত্য প্রকাশ করেছেন।"
এই সূত্র ধরে এরপর আমরা নয়নিকা মুখোপাধ্যায়ের জার্নালটি খতিয়ে পড়ি। সেখানে ২৪ নম্বর পাতায় কিশোর পারেখের ছেলে স্বপন পারেখের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ উঠে আসে ও লেখা হয় যে স্বপন জানিয়েছেন, এই ছবি আসলে ভারতীয় সেনা সদস্যের যারা পাকিস্তানি গুপ্তচর সন্দেহে পরীক্ষা করে দেখছিল কেউ অস্ত্র নিয়ে আসছে কি না। স্বপন আরও বলেন, এই সেনা সদস্য যে ভারতীয়, সেই সত্যতা বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকেই স্বীকার করা হয়েছিল কারণ একাত্তরের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাই SLR আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছিল। পাকিস্তানি সেনা চিনা বন্দুক-সহ একে ৪৭ এবং জার্মান অস্ত্র ব্যবহার করেছিল।
গুজবের উৎস কীভাবে?
নয়নিকা মুখার্জীর জার্নাল থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকার একটি প্রতিবেদনে ছবিটি ব্যবহার করে ক্যাপশনে লেখা হয়েছিল, "ওরা মানুষ, বর্বরদের কাছে সেটা পরিচয় নয়—বড় কথাটি ছিল ওরা হিন্দু না মুসলমান। তাই উলঙ্গ করে দেখছে।" নীচে সেই বিতর্কিত প্রতিবেদনের স্ক্রিনশট দেওয়া হল যা থেকে গুজবের সূত্রপাত হয়।
এরপর আমরা বাংলাদেশ মুক্তিযুক্ত নিয়ে কিশোর পারেখের প্রকাশিত বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ খুঁজে পাই (আর্কাইভ)। এই বইয়ের ২২ নম্বর পাতায় আলোচ্য ছবিটি দেখতে পাওয়া যাবে। সেই ছবির সঙ্গে ইংরেজি ক্যাপশনে সেই কথাই লেখা ছিল Bangladesh Old Photo Archive-এর পেজে লেখা হয়েছিল।
চিত্র সাংবাদিক কিশোর পারেখের জন্ম গুজরাটের ভাবনগরে। তিনি সাউথ ক্যালিফোর্নিয়ায় চিত্র নির্মাণ এবং তথ্যচিত্র ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ভারতে ফিরে তিনি হিন্দুস্তান টাইমসের চিফ ফটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করেন।
ফলে বোঝাই যাচ্ছে, একটি অসম্পর্কিত ছবি কীভাবে মিথ্যে ও বিভ্রান্তিকর দাবি-সহ ছড়ানো হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
১৯৭১ সালের এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে তৎকালীন পাকিস্তানের সেনা কীভাবে ধর্ম যাচাই করছে যাতে অহিন্দুদের হত্যা করা যায়।
এই ছবিটি চিত্র সাংবাদিক কিশোর পারেখের তোলা। তিনি তাঁর বইতে লিখেছেন যে এখানে এক ভারতীয় সেনা পাকিস্তানি গুপ্তচর সন্দেহে পরীক্ষা করে দেখছে যে লুঙ্গির ভেতর অস্ত্র লোকানো আছে কি না।