দুর্গাপুজোর সময় বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘটা ঘটনা নিয়ে নেটদুনিয়া এখনও সরগরম। ওপার বাংলার একাধিক ভিডিও, ছবি ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। নেটিজেনদের একটা বড় অংশ অনেক বিভ্রান্তিকর দাবিও ছড়িয়েছেন গণমাধ্যমে।
তবে গত মাসের ঘটনার পর একটি ছবি বিশেষ করে ফেসবুক ও টুইটারে ছড়িয়ে গিয়েছে। যেখানে হাতে শাখা-পলা পরা এক হিন্দু মহিলাকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাঁকে ধরে থাকতে দেখা যাচ্ছে আরেক ব্যক্তিকে। তাঁরও চোখে মুখে শোকের ছাপ স্পষ্ট। এই ছবিটি শেয়ার করে বাংলাদেশে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঘটা ঘটনার প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। 'হ্যাশট্যাগ সেভ বাংলাদেশি হিন্দু' ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের হিন্দুদের রক্ষা করার আবেদন জানানো হয়েছে।
কোথাও আবার এই একই ছবি পোস্ট করে লেখা হয়েছে, "বাংলাদেশের নতুন নাম 'জিহাদিস্তান'। হিন্দুদের পুজো মণ্ডপ, প্রতিমা, বাড়িঘর, দোকান জিহাদিরা ধ্বংস করে দিয়েছে।"
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল পোস্টগুলির আর্কাইভ এখানে এখানে ও এখানে দেখা যাবে।
ইন্ডিয়া-টুডের অ্যান্টি-ফেক নিউজ ওয়ার রুম (আফয়া) অনুসন্ধান করে দেখেছে, এই ছবির সঙ্গে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনার, বা সাম্প্রদায়িক হিংসার কোনও সম্পর্ক নেই। ছবিটি আসলে ৬ বছরের পুরনো।
অনুসন্ধানে নেমে সবার প্রথম আমরা ভাইরাল ছবিটির ইমেজ রিভার্স সার্চ করে দেখি। তখন আমাদের সামনে ২০১৯ সালের বাংলাদেশি হিন্দুদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করার একটি লিঙ্ক উঠে আসে। যেখানে এই ভাইরাল ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছিল। ফলে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে ছবিটি সাম্প্রতিক সময়ের নয়।
আরেকটু খোঁজাখুঁজির পর আমরা নিউ ইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন দেখতে পাই। সেই প্রতিবেদনের থাম্বনেলে এই ছবিটি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রতিবেদনের ভিতরে এই ছবিটি কোথাও ছিল না। ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ প্রকাশ পাওয়া ওই প্রতিবেদনে লেখা ছিল, ঢাকা শহরের অদূরে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে পদপিষ্ট হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। একটি গুজব থেকে এই ঘটনা ঘটে বলে জানানো হয় পুলিশের তরফে।
সেই সূত্র ধরে গুগলের টাইমলাইন ফিল্টার অন করে আমরা কি-ওয়ার্ড সার্চ করি। তখন ওই বছর ২৭ মার্চ প্রকাশ পাওয়া এনডিটিভি ও ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন উঠে আসে। সেখানেও উল্লেখ করা হয় যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন পদপিষ্ট হয়ে ১০ জন হিন্দু ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে ঢাকায়। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট সালে বাংলাদেশে এই ঘটনা যে ঘটেছিল সেই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়।
ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমরা কি-ওয়ার্ডের মাধ্যমে ভিডিও সার্চ শুরু করি। তখন ফের নিউ ইর্য়ক টাইমসের একটি ভিডিও আমরা দেখতে পাই। সেই ভিডিওর ১৩-১৪ সেকেন্ডের মাথায় এক ব্যক্তিকে দেখতে পাওয়া যায়। ওই ব্যক্তির পোশাক ও তাঁর অবয়বের সঙ্গে ভাইরাল ছবিতে থাকা দ্বিতীয় ব্যক্তিকে আমরা মিলিয়ে দেখি। যা একেবারে মিলে যায়। ফলে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে ভাইরাল ছবিতে থাকা ওই ব্যক্তিই দুর্ঘটনার দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন।
টাইমস অব ইন্ডিয়াতেও ওই একই দিনে, অর্থাৎ ২০১৫ সালের ২৭ মার্চ সংবাদ সংস্থা এএনআই-এর একটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়, যার দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায় সেটিই দুর্ঘটনাস্থলের ছবি।
তবে ভাইরাল হওয়া ছবির ওই মহিলার বিষয়ে পোক্ত তথ্য মেলে ওই বছরেই প্রকাশিত পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম 'ডন' থেকে। 'হিন্দু উৎসবে পদপিষ্ট হয়ে ১০ ভক্তের মৃত্যু' শীর্ষক এই প্রতিবেদনে প্রথমেই ভাইরাল হওয়া ছবির ওই মহিলাকে দেখা যায়। সেই সঙ্গে দেখা যায় দ্বিতীয় ব্যক্তিকেও। ছবিটির ক্যাপশনে লেখা ছিল, 'নারায়ণগঞ্জে আত্মীয়ের দেহ দেখার পর ভেঙে পড়েছেন এক বাংলাদেশি মহিলা।' এর ফলে এটাও পরিষ্কার হয় যে ওই দুর্ঘটনায় মহিলাটি কোনও আপনজনকে হারিয়েছেন।
সুতরাং, এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে বাংলাদেশে হিন্দুদের রক্ষার আহ্বান জানিয়ে, বা হিন্দুদের উপর হামলা বন্ধ করার ডাক দিয়ে যে ছবি ভাইরাল হয়েছে, তার সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনার, বা হিংসার কোনও সম্পর্ক নেই।
কান্নায় ভেঙে পড়া মহিলার ছবি দিয়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁদের রক্ষা করার আবেদন।
ভাইরাল হওয়া ছবিটির সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনা, বা ধর্মীয় হিংসার কোনও যোগাযোগ নেই। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে ঢাকার অদূরে হিন্দুদের এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পদপিষ্ট হয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সেই সময় স্বজন-বিয়োগের শোকে কান্নায় ফেটে পড়েন ওই মহিলা।