দু'দিনের বঙ্গ সফর শেষ করে গন্তব্যের পথে রওনা দিয়েছেন অমিত শাহ। যাওয়ার আগে রাজ্য়বাসীর উদ্দেশ্য তাঁর বার্তা,তৃণমূল সরকারকে উৎখাত করে বিজেপিকে একটা সুযোগ দিন। সোনার বাংলা গড়ে দেখাব আমরা। রাজনৈতিক মহলের ধারণা,শুধু নেতা কর্মীদের উৎসাৎ দিতেই বঙ্গ সফরে আসেননি বিজেপির সেকেন্ড ইন কমান্ড। এখন থেকে বিধানসভা ভোট পর্যন্ত রাজ্য়ে বিজেপির চালকের আসনেই বসবেন তিনি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদনেই সিদ্ধান্ত হবে রাজ্য় নেতৃত্বের।
ইন্ডিয়া টুডে টিভি-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তার ইঙ্গিতও দিয়েছেন শাহ। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে বিজেপির পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে, অমিত শাহ বলেছেন-'হ্যাঁ , বাংলার দিকে আমাদের নজর রয়েছে।'দিল্লিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে,রাজ্য় নেতৃত্বের থেকে এবার একে একে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চাইছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকী জেলা সভাপতিও কে হবেন তাতেও নাক গলাবেন তাঁরা। সেকারণেই বঙ্গ সফরে জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অমিত শাহ। স্থানীয় নেতাদের মনোবল জোগানোর পাশাপাশি সবকিছু চাক্ষুষ করতে চান নিজেই। কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনে নিয়েই তাই বৈঠক করেন তিনি।
রাজ্য়ে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থনের পর তিন উপনির্বাচনে ভরাডুবি হয় বিজেপির। খোদ বিজেপির রাজ্য় সভাপতি দিলীপ ঘোষের ছেড়ে আসা বিধানসভা আসনও হাতছাড়া হয়। সাংসদ হওয়ার পর যার উপনির্বাচন হয় নিয়ম মেনেই। উপনির্বাচনের এই হার ভালো চোখে দেখেনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রাজ্য় বিজেপির কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে,বিজেপির মুখ্য়মন্ত্রী পদপ্রার্থীর মুখ। মমতা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়ের বিকল্প খুঁজতে হচ্ছে বিজেপিকে।
সেকারণে অমিত শাহ বাংলায় এলেও দল চিন্তিত নয় বলছে তৃণমূল। দলের সাংসদ সৌগত রায় বলছেন, 'রাজ্য়ে অমিত শাহের আগমন আধিকারিকদের ওপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু তাঁর বঙ্গ সফর নিয় ভাবিত নয় দল। উনি এসেছেন নিজেদের দেলর কোন্দল মেটাতে। ওদের দলের রাজ্য় সভাপতির সঙ্গেই অন্য় নেতাদের সংঘাত চলছে।সেইসব সমস্যা মেটাতেই তাঁর বাংলায় আসা। দলের প্রাক্তন সভাপতি হিসাবে তিনি দলকে উৎসাহ জোগাতে এসেছেন। তবে আমার মনে হয়, উনি আগামী নির্বাচনের অনেক আগেই এখানে চলে এলেন।'
বুথ বাংলা
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী বছর মে মাসেই হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। যা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছে বিজেপি। ত্রিপুরার মডেলের মতো বঙ্গেও বুথ স্তরে জোর দিতে চাইছে দল। ইতিমধ্য়েই ত্রিপুরায় বামেদের শাসন সরিয়ে গেরুয়া ধ্বজা উড়িয়েছে বিজেপি। সেখানেও 'পান্না প্রমুখ' নীতি নিয়ে লড়েছে বিজেপি। ২০১৮ সালের ভোটে জিততে পার্টি কর্মীদের প্রতিটি ভোটার তালিকার ব্যক্তিগত তথ্য় জোগাড় করা হয়েছে। ভোটে জিততে এই তালিকার প্রতিটি পাতা ধরিয়ে দেওয়া হয় কর্মীদের হাতে। যাতে ব্যক্তি পরিচিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে সবার। সেই একই বুথ অধ্যক্ষ-বুথ কমিটি ফর্মুলা নিয়ে এবার বাংলায় ঝাঁপাবে দল। ত্রিপুরায় ২৫ বছরের মানিক সরকার নেতৃত্বাধীন বাম সরকারকে উৎখাত করতে কাজে আসে বিজেপির এই ফর্মুলা। যেখানে ২০১৩ সালের ২ শতাংশ ভোট থেকে ২০১৮ সালে ৪৩ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্য় ত্রিপুরা মডেলই এবার বিজেপির বিধানসভার নকসা।
একই রাজনৈতিক পরিস্থিতি হয়েছে বাংলায়। ৪২ শতাংশ ভোট শেয়ারে পৌঁছে গিয়েছে বিজেপি। শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস থেকে মাত্র ৩ শতাংশ দূরে রয়েছে তারা। এই উত্থানের ধারা বজায় রাখতে ইতিমধ্য়েই বুথ স্তরে নেতাদের ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেছে বিজেপি। সূত্রের খবর, এর মধ্য়ে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এই বিষয়গুলি।
১) এলাকায় যারা প্রভাবশালী এমন ব্যক্তিত্বদের খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে।
২) বুথ কমিটি গঠনে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে।
৩) বুথ অধ্য়ক্ষ নিয়োগ
৪) স্থানীয় ভোটারদের ক্ষেত্রে সমস্যা নির্বাচন স্থির করা।
৫) সমস্যা সমাধানে উচ্চতর নেতৃত্বের কাছে বিষয়টি পৌঁছে দেওয়া।
৬) গ্রামের ঘরে থাকা মহিলা মহিলা ভোটারদের নিশানা করা।
৭) হিংসার থেকে ভোটারদের সুরক্ষিত করে তাদের মনোবল বাড়ানো।
৮) ছাপ্পা ভোট রুখতে বুথ স্তরে শক্ত হাতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা
৯) নির্বাচনের নিয়ম ও ভোট গণনার বিষয়ে কর্মীদের অবহিত করা।
১০) নির্বাচন কমিশনের আদর্শ আচরণ বিধি ও নিয়ম সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেওয়া।
সূ্ত্রের খবর,বুথ স্তরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যে খুব একটা সহজ হবে না, তা ভালো করেই জানে বিজেপি। বিশেষ করে মুসলিম অধ্য়ুষিত মালদা ,মুর্শিদাবাদের মতো এলাকায় বুথ স্তরে প্রতিনিধি দিতে গিয়ে সমস্যা পড়তে হচ্ছে তাদের। রাজ্য়ের ৭৮০০০ বুথে অনেক জায়গাতেই 'ফিয়ার ফ্যাক্টর' কাজ করছে। ফলে সেখানে বুথে প্রতিনিধি দেওয়া সমস্যা তৈরি হচ্ছে বিজেপির কাছে। মৌখিক ভরসায় চিড়ে ভিজছে না এখানে।
পরিসংখান বলছে, ক্রমশই রাজ্য় বেড়ে চলেছে রাজনৈতিক হিংসা। এ বিষয়ে বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, 'রাজনৈতিক খুনোখুনি পশ্চিমবঙ্গ নতুন ঘটানা নয়। ১৯৭২ সালে সিদ্ধার্থ শংকর রায়ের আমল থেকেই এই হিংসা রাজ্য় রাজনীতির অঙ্গ। পরবর্তীকালে বামেরা সুচতুরভাবে এই হানাহানি জারি রাখে। কিন্তু মমতার শাসনকালে রাজ্য়ে রাজনৈতিক হিংসা স্থায়ীভাবে থেকে গিয়েছে।'
বিশ্বনাথবাবু বলেন, 'স্থানীয় স্তরে হিংসা এখন রাজ্য় রাজনীতির একটা অংশ। আমরা কেউ জানি না এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? জায়গায় জায়গায় নিজের কর্তৃত্ব কায়েম করতে রাজনৈতিক হিংসা ঘটায় শাসক দল। যেখানে পুলিশ প্রশাসন দেখেও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে।'