শেখ হাসিনার পদত্যাগের পরও বাংলাদেশে হিংসা অব্যাহত। আর প্রতিবেশী দেশে নতুন করে অশান্তি ছড়াতেই পশ্চিমবঙ্গের বাজারে টান পড়েছে টাটকা পদ্মার ইলিশের। পাশাপাশি এবারের পুজোয় পদ্মার ইলিশ এপারের বাঙালির পাতে পড়বে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদলের সরাসরি প্রভাব পড়েছে হাওড়ার পাইকারি মাছ বাজারে। সীমান্তে ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দু'দেশের মাছ ব্যবসায়ীরা কয়েক কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন তো হচ্ছেনই। হাওড়ার মাছ ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ৮ থেকে ১০টি ট্রাকে প্রায় ৮০০ মেট্রিক টন পাবদা, পারশে, ভেটকি, ট্যাংরা, পমফ্রেট এবং অন্যান্য মাছ আমদানি হয়। আবার ভারত থেকে ১০ থেকে ১২ টি ট্রাকে প্রায় ১০০ মেট্রিক টন বোয়াল, রুই, কাতলা, ভেটকি, কাজরি এবং অন্যান্য মাছ বাংলাদেশে রফতানি হয়। ব্যবসা বন্ধ থাকার কারণে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি টাকা করে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি কীভাবে তাঁরা সামাল দেবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। সব থেকে বড় সঙ্কট ইলিশ মাছের আমদানিতে।
উল্লেখ্য, এবার বর্ষার মরশুমের শুরু থেকেই পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ইলিশের দাম চড়া। খুচরো বাজারগুলিতে ইলিশের ঢল নেমেছে—এমন ছবি এখনও পর্যন্ত দেখা যায়নি। দামের আঁচে ছ্যাঁকা লাগলেও অনেকে ইলিশ কিনছিলেন। কিন্তু গত এক-দু’দিনে নোনা জলের রুপোলি ফসলের দর সাধারণের ধরাছোঁয়ার একেবারে বাইরে চলে গিয়েছে। এর অন্যতম কারণ, বাংলাদেশে চলমান অশান্তি ও অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ইলিশের জোগানের একটা বড় অংশ আসে বাংলাদেশ থেকে। এবার এখনও পর্যন্ত সরকারিভাবে বাংলাদেশের ‘কাঁচা’ ইলিশ এপার বাংলার বাজারগুলিতে আসেনি। তবে কাগজেকলমে রফতানি শুরুর আগেই ঘুরপথে বা বেআইনিভাবে এখানকার বাজারগুলিতে পদ্মার ইলিশ ঢুকে যায়। মরশুমের শুরুর দিকে সেভাবেই কিছু ইলিশ এসেছিল। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এই ধরনের ‘বেআইনি’ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্থানীয়ভাবে ইলিশের জোগানে ঘাটতি আছেই। তার উপর ওই ‘চোরা’ ইলিশ না থাকায় বাজার আগুন হয়ে রয়েছে।
কত দামে এখন মিলছে ইলিশ?
ইলিশের টান এমনিতেই ছিল তার মধ্যে বাংলাদেশে অশান্তি ছড়াতেই এক ধাক্কায় খুচরো বাজারে দামও বেড়ে গিয়েছে। এক কেজির একটু বড় আকারের মাছের দাম কেজি পিছু ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় মাছের দাম ৫০০ টাকা অবধি বেড়েছে। টাটকা বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এদেশে। বাজারে সাধারণত ১২০০ ও ১৩০০ গ্রামের ওজনের ইলিশের দাম কেজিপিছু ১৫০০ টাকা থেকে ১৬০০ টাকা করে বিক্রি হয়। এখন জলঙ্গির বাজারে ইলিশ বিকোচ্ছে ২০০০ টাকা কেজি দরে। সর্বোচ্চ ১৮০০ গ্রামের ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে বাজারে। সেই ইলিশের দাম ২৫০০ টাকা কেজি। ওপারে ইলিশের দাম না মিললেও এপারে পাঠাতে পারলে বিপুল মুনাফা হচ্ছে পাচারকারীদের। ফলে চোরাপথে ইলিশ কিনে বাজারে বিক্রি করে ভালোই মুনাফা করছে খুচরো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সেক্ষেত্রেও জোগান নেই। ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অতুলচন্দ্র দাসের কথায়, ‘চোরাপথে ওপার বাংলা থেকে যে ইলিশ ঢোকে, তা বন্ধ হয়ে যাওয়াতেই আচমকা দাম বেড়েছে। হিমঘর থেকে যে বড় সাইজের মাছ আসছে, খুচরো বাজারে তার দাম ২,২০০ থেকে ২,৪০০ টাকায় পৌঁছেছে। ৮০০-৯০০ গ্রামের মাছ ১,৮০০ টাকা কেজি দরে মিলছে। ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ইলিশ হলে তার দর ৭০০ টাকার বেশি।’ বাজার ঘুরে ক্রেতারা বলছেন, গত তিন-চারদিনে ইলিশের দাম ৪০০-৫০০ টাকা বেড়েছে। প্রসঙ্গত, বাজারে যে ইলিশ মিলছে, তাতে দিঘা-ডায়মন্ডহারবারের জোগান যেমন আছে, তেমনই থাকছে মায়ানমার, মুম্বই বা গুজরাতের মাছ। বাইরের মাছের স্বাদ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দাম সেই আকাশছোঁয়াই। ক্রেতাকে বেকায়দায় পেলে সেই মাছই পদ্মাপারের বলে গছিয়ে দিতে দু’বার ভাবছেন না একাংশ। এই অবস্থায় বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি কবে ঠিক হয় সেদিকে তাকিয়ে আছেন মাছ ব্যবসায়ীরা।
পুজোয় আসবে পদ্মার ইলিশ?
প্রতিবছর পুজোর মরশুমে পশ্চিমবঙ্গের মাছ বাজারে পদ্মার ইলিশের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। এবার চাহিদা থাকলেও আশা মিটবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ ব্যবসায়ীদের মধ্যেও। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার ইলিশ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ফলে এপার বাংলায় পদ্মার ইলিশ আশা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বছর ছয়েক আগে কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার পর বাংলাদেশ সরকার দুর্গা পুজোর আগে ইলিশ রফতানিতে অনুমতি দেয়। হাসিনা সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের চুক্তি হয় এবং প্রতি বছর সেই চুক্তি রিনিউ করার ব্যাপারে দুই দেশ সম্মত হয়। বিগত ৫ বছর ধরে অগাস্ট মাসের ১০ থেকে ১৮ তারিখের মধ্যে সেই চুক্তি নবীকরণ হয়ে আসছে। অগাস্ট মাসে এই দেশের আমদানীকারীদের সঙ্গে বাংলাদেশের রফতানিকারীদের এগ্রিমেন্ট হয়। দ্বিপাক্ষিক প্রস্তাবে সই হয়। তারপর সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দুর্গাপুজোর দশমী পর্যন্ত পদ্মার ইলিশ আসতে শুরু করে এই দেশে বা এই রাজ্যে। এই চুক্তি অনুয়ায়ী ২০২৩ সালে অর্থাৎ গত বছর বাংলাদেশ ৪৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল। তবে টেকনিক্যাল কারণে শেষ পর্যন্ত আমদানি করা গেছিল ১৩০০ মেট্রিক টন। একইভাবে ২০২২ সালে ৪০০০ মেট্রিক টন দেওয়ার ব্যাপারে হাসিনা সরকার সম্মত হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেশে আনা সম্ভব হয়েছিল ২৬০০ মেট্রিক টন রুপোলি শস্য। এবার কি হবে? উত্তর জানেন না ইলিশ আমদানিকারকরা। ওয়েস্ট বেঙ্গল হিলশা ট্রেডার্স ফেডারেশন এর সভাপতি অতুল চন্দ্র দাস সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, চুক্তি রিনিউইয়ালের সময় প্রায় এসে গিয়েছে। হাসিনা সরকারের রফতানি বিভাগের আধিকারিকরা কেউ নেই। নতুন প্রশাসন এই ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবেন জানা নেই। ফিস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি সৈয়দ আনোয়ার মকসুদ জানিয়েছেন, তাঁরা এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি লেখার কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক গণ্ডগোলের কারণে কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। নতুন সরকার এলে তাদের কাছে একই আবেদন করা হবে। তারা যদি ইলিশ রফতানি অনুমতি দেয় তবেই বাঙালির পাতে দেখা যেতে পারে ওপার বাংলার রুপোলি ইলিশ।