কিছুদিন আগে রাজ্যের পরিবহণ দফতর জানিয়েছে, শহরে ট্রাম চালানোয় সমস্যা হচ্ছে। তাই যানজট এড়াতে মাত্র একটি রুটেই ট্রাম চলবে প্রতীকী পরিষেবা হিসেবে। বাকি রুটগুলি চিরতরে বন্ধ থাকবে। রাস্তা থেকে তুলে নেওয়া হবে ট্রামের লাইন ও তার। বন্ধ হবে ট্রাম ডিপোগুলিও। এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে শহরবাসীর একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, যানজটের অজুহাতে ট্রাম বন্ধ করে ডিপোগুলির বিপুল জায়গা বিক্রি দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।
বিভিন্ন মহলে কানাঘুঁষো, রাজ্য ট্রামগুলি সরিয়ে নেওয়ার এবং ধীরে ধীরে কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানির (সিটিসি) সম্পত্তি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা গেছে, শহরে এখনও ১১৬.৬২ কিলোমিটার ট্রাম ট্র্যাক রয়েছে। কিন্তু ট্রামগুলি শুধুমাত্র সেই ট্র্যাকের ৩৩ কিলোমিটারে চলে৷ আগে কলকাতায় শহরে ৬টি বড় ট্রাম ডিপো ছিল। বড়গুলির মধ্যে দুটি কার্যকরী। অন্যান্য ডিপোর জমির সম্পত্তি বেসরকারী সংস্থার কাছে বিক্রি করা হয়েছে। সেখানে হাউজিং কমপ্লেক্স তৈরি করা হচ্ছে।
রাজ্য সরকার কলকাতায় ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ জানিয়েছে। এর আগে কলকাতার রাস্তায় সব রুটে ট্রাম চালানোর দাবিতে হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা হয়। সেই মামলা এখনও বিচারাধীন। সেই পরিস্থিতিতে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানিয়েছেন, সরকার ধর্মতলা থেকে ময়দান অবধি হেরিটেজ আকারে একটি সুসজ্জিত ট্রাম চালাবে। বাকি রুটে ট্রাম চলবে না।
ট্রাম ডিপোর বিপুল জমি রিয়েল এস্টেটের জন্য বিক্রির প্রতিবাদও উঠছে সর্বত্র। অভিযোগ, টালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর ২৪৪.৫ কাঠা জমি ১৮১ কোটি টাকায় বিক্রি করা হয়েছে বেলানি গোষ্ঠীকে। গ্যালিফ স্ট্রিটের ১৪.৯৫ কাঠা জমি বিক্রি করা হয়েছে ৬.৫১ কোটি টাকায় গোয়েঙ্কা গোষ্ঠীকে। এই গোষ্ঠীকেই বিক্রি করা হয়েছে খিদিরপুরে ২১.৮৮ কাঠা এবং কালীঘাট ট্রামডিপোর ১২.৩৩ কাঠা জমি। খিদিরপুরে ১৩.২১ কোটি এবং কালীঘাটে ৪.০১ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে জমি। বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোর ৫২ কাঠা এবং শ্যামবাজার ট্রাম ডিপোর ৩১ কাঠা জমি ইতিমধ্যেই বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের অভিযোগ, ট্রামের শ্লথ গতি অজুহাত মাত্র। ধর্মতলা-খিদিরপুর রুটে কোনও যানজট নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও সেখানে ট্রাম বন্ধ। আমফানের সময়ে ওই রুটে ওভারহেডের তার ছিঁড়ে যাওয়ায় কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়ার পরেও কাজ হয়নি, উপরন্তু তারগুলি চুরি হয়ে গেছে। অন্যদিকে গালিফ স্ট্রিট থেকে বিবাদী বাগ রুট যা গেছে রবীন্দ্র সরণির ওপর দিয়ে। সেখানেও বন্ধ ট্রাম চলাচল।
কলকাতা ট্রাম ইউজার্স অ্যাসোসিয়েশনের তরফে দেবাশিস ভট্টাচার্য 'বাংলা ডট আজতক ডট ইন'কে বললেন, 'পুরোটাই দুর্নীতি। গোয়েঙ্কা গোষ্ঠী কালীঘাট, খিদিরপুর ডিপো আর গ্যালিফ স্ট্রিটের অংশ কিনে স্টোরেজ বানিয়েছে। বেলগাছিয়া ডিপোর কিছু জায়গা কিনেছে একটি আবাসন সংস্থা। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমাদের বলেছেন, জমিগুলি যখন বিক্রি হচ্ছে, তখন আপনারা আসেন নি কেন। কারণ জমি বিক্রি হয়ে গেলে সমস্যা হয়। এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আদালতের দিকে তাকিয়ে রয়েছ আমরা। শহর থেকে ট্রাম তুলে নেওয়া মানব না।'
স্থপতিবিদ দীপঙ্কর সিনহা বললেন, 'কলকাতা শহরে যদি আমরা বলি ট্রান্সপোর্টের জমি কম রয়েছে, তাহলে তারথেকে আবার বিক্রি করা মানেই তো আরও কমে যাবে। ট্রাম চলবে না, কিন্তু ট্রামের জমি বিক্রি করে দিতে হবে। নীতিবিহীন কাজ করছে সরকার। জমি এমনভাবে বিক্রি করা হয়েছে, তাতে বাকি জমিও বিক্রি হবে না। সেগুলিও ওই সংস্থাকেই জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হবে। এটা দুর্নীতি। কোনও আইন মানা হয়নি। পরিবহণ পরিকল্পনার সঙ্গে এই জমি বিক্রির কোনও সঙ্গতি নেই। এই জমি বিক্রি করে দেওয়া যায় না। ট্রামকে উন্নত না করে ট্রামের সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে। সেখানে সব বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।'
জানা যাচ্ছে, ২০১১ সালে যেখানে কলকাতার ৩৭টি রুটে ট্রাম চালানো হতো, গাড়ি মজুত ছিল প্রায় ২২০টি। তার মধ্যে প্রতিদিন চালানো হতো ১০০ থেকে ১১০টি। এখন অর্থাৎ ২০২৩ সালে মাত্র ২টি রুটে ট্রাম চালানো হয়। এখন মজুত ট্রামের সংখ্যা ২০টি, চলে দিনে ১১ থেকে ১২টি। স্থায়ী কর্মীর সংখ্যাও কমে গেছে হুহু করে। কিন্তু এখনও ৭৫ থেকে ৮০টি ট্রাম এমন অবস্থায় আছে যে পুরানো রুট চালু করে সেগুলিকে নিয়মিত চালানো সম্ভব। ট্রাম লাইনের ওপর পিচ ঢেলে দিতে চাইছে সরকার, খুলে নেওয়া হচ্ছে ওভারহেড তার। অভিযোগ, ৩৭টি ট্রামকে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন।
অভিযোগ, টালিগঞ্জ, কালীঘাট, বেলগাছিয়া, গ্যালিফ স্ট্রিট, খিদিরপুর— এই ৫টি ট্রাম ডিপোর প্রায় ৩৫০ কাঠা জমি ২৩০ কোটি টাকায় ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। সূত্রের খবর, টালিগঞ্জের জমিতে শপিং মল, গড়িয়াহাটের জমিতে কফি শপ ইত্যাদি পরিকল্পনা হচ্ছে।