বাংলা ভাষায় দাওয়াত-পানি বিতর্কে মুখ খুললেন বিশিষ্ট লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তাঁর মতে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন সেটা একদিক থেকে যেমন ঠিক তেমনই শুভাপ্রসন্ন যা অভিযোগ করেছেন সেটাও সত্যি। লেখিকার মতে, বিদেশি শব্দ একটা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। তবে বাংলাদেশে বা বাংলা ভাষায় জোর করে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আরবি, উর্দু ইত্যাদি শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে। যা মোটেও স্বাস্থ্যকর নয়।
তসলিমা নাসরিন বলেন, 'বিদেশি শব্দ আসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন ইসলামিকরণ চলছে। একদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ঠিক বলেছেন তেমনই শিল্পী শুভাপ্রসন্নও ভুল বলেননি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করে। এটা ঠিক। বাংলায় কোনও বাক্য লিখতে গেলে পার্সি শব্দ চলে আসবেই। আদালত সম্পর্কিত যে শব্দগুলো আছে প্রায় সবই পার্সি শব্দ। এছাড়া আরবি শব্দও রয়েছে। আসলে যত মানুষ বাংলায় এসেছে তাদের কাছ থেকে সেই শব্দ আমরা পেয়েছি। গ্রহণও করেছি। যেমন ইংরেজরা এসেছিল বলেই এত ইংরেজি শব্দের ব্যবহার এখন। চেয়ার-টেবিল ইত্যাদি এর উদাহরণ। এই শব্দগুলো ছাড়া দৈনন্দিন জীবন কার্যত অচল। এই শব্দগুলো আমাদের ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে।'
লেখিকার আরও সংযোজন, 'এটাও ঠিক ইসলামাইজেশন বাংলাদেশে যখন প্রচণ্ডভাবে শুরু হয়েছে তখন ইচ্ছে করেই বাংলা ভাষায় জোর করে আরবি শব্দের ব্যবহার করা হচ্ছে। যার কোনও দরকার নেই। আমাদের ফ্যামিলিতে মা-বাবা-বউদি-দিদি ব্যবহার করতাম। এখনও করি। অনেক পরিবারে করে। তবে কিছু মৌলবাদী পরিবার আছে যারা মনে করে বাংলা ভাষা থেকে বাঙালি মুসলমানের ভাষা আলাদা হওয়া উচিত, তারা জোর করে বাংলার পরিবর্তে অন্য শব্দ ব্যবহার করে। অথচ সেই শব্দগুলো বাংলা ভাষাতেও আছে। মুসলিমদের অনেকেই মনে করে, আরবি তাদের ভাষা। তবে এই তথ্য ভুল। আদতে নন-আরবিক মুসলিমের সংখ্যায় পৃথিবীতে বেশি। এদের যে পূর্বপুরুষ বাঙালি হিন্দু, সেটা অস্বীকার করে এরা ভাবতে চায়, আরবের মানুষ এদের পূর্বপুরুষ। তবে তা ঐতিহাসিকভাবেই ভুল। এতে ক্ষতি হচ্ছে বাংলা ভাষার। সেই দিক থেকে বিচার করলে শুভাপ্রসন্ন ঠিক বলেছেন।'
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য নিয়ে লেখিকা বলেন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলছেন সেটিও ঠিক। সত্যিই তো। যত বেশি বিদেশি শব্দ আসবে তত ভাষা সমৃদ্ধ হবে। তবে মনে রাখতে হবে, যে শব্দগুলো জোর করে আসে বা প্রবেশ করানো হয়, সেগুলো বেশিদিন থাকেও না। সুতরাং আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, শব্দ যদি অধিকাংশ মানুষ গ্রহণ না করে তাহলে সেই শব্দও বেশিদিন থাকবে না। যুগে যুগে রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয় ইত্যাদি নানা কারণে ভাষার মধ্য়ে নির্দিষ্ট শব্দ ঢোকানোর প্রবণতা আজকের নয়। এটা চলে আসছে। জোর জবরদস্তি। ভাষার বিবর্তন হচ্ছে।'
তসলিমা নাসরিনের মতে, বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দের ব্যবহার বেশি হচ্ছে এটার থেকেও বেশি আতঙ্কের হল বাঙালির নিজের ভাষাতেই কথা না বলা। তিনি বলেন, 'ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছে এখনকার শিশুরা, তাদের বাংলা শেখানোর উপর জোরই দেওয়া হচ্ছে না। নিজেদের শিক্ষিত দেখানোর জন্য ইংরেজিতে কথা বলতে শেখানো হচ্ছে। বাংলা তারা বলছেই না। বাবা-মারাও আজকাল বাংলা শেখাচ্ছে না। এটাই হল সবথেকে আতঙ্কের।'