অদ্ভুত রোমান্টিকতার সাথে অরণ্যের ছায়া মাখা আদিম রহস্যে ঘেরা মুখায়ব ছিল তাঁর। মাদকতা ছিল তাঁর কণ্ঠ মাধুর্যে। সহজ সরল সংলাপে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী এক নায়িকা! উত্তমের নায়িকা অঞ্জনার কোন উপমা খুঁজে পাওয়া যায় না।
সে অনেক দিনের কথা। তখন স্কুলে পড়ি। দিদিরা একদিন বাড়িতে ফিরে হৈ চৈ ফেলে দিল। আমাদের স্কুলের এক্স-স্টুডেন্ট আরতিদি সিনেমায় নেমেছে! তখনকার দিনে গ্রাম বাংলার ছেলে মেয়েদের কাছে সিনেমায় নামার স্বপ্নটা ছিল নিতান্তই কষ্টকল্পিত।
ধীরে ধীরে শহরময় আলোচনাটা ছড়িয়ে পড়ল। কোচবিহারের বিভূতিভূষণ ভৌমিকের মেয়ে আরতি ভৌমিক বাংলা ছবির রুপালি পর্দায় হয়ে গেলেন অঞ্জনা ভৌমিক। ১৯৬৪ তে পীযূষ বসুর পরিচালনায় "অনুষ্টুপ ছন্দ"। এরপরই উত্তম কুমারের সাথে একে একে "থানা থেকে আসছি", "রাজদ্রোহী", "নায়িকা সংবাদ", "কখনো মেঘ", "চৌরঙ্গী", "সুখ সারি", "রৌদ্র ছায়া"। এরমধ্যে চারটি ছবি সেকালে সুপারহিট। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন "মহাশ্বেতা" ছবিতে। বাঙালির হার্টথ্রব সুচিত্রা সেন তখন মধ্য গগনে। তবু সুদূর উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের অজানা এক গাঁয়ের মেয়ে অঞ্জনা ওরফে আরতি উত্তম কুমারের বিপরীতে দাপিয়ে অভিনয় করে বাঙালির হৃদয়ে তাঁর স্থান পাকা করে নিলেন।
১৯৮৭ সালে শেষ ছবি "নিশি বাসর" ছবিতে অভিনয় করার পর তিনি চলে যান অন্তরালে। তারপর আর কোনদিন তাকে দেখা যায়নি অভিনয় জগতে।
আমাদের মাসিমা, সুনীতি একাডেমীর প্রাক্তন শিক্ষিকা প্রয়াতা প্রতিমা চক্রবর্তীর কাছে শুনেছি, তাঁর ছাত্রী আরতি ছিল অত্যন্ত ডানপিটে, গাছে চড়তো, দুরন্ত সাইকেল চালাতো। তবে ও ছিল ভালো স্পোর্টসওম্যান, নজর কারা স্প্রিন্টার। ঘরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তোর্ষার মতই উচ্ছল ছিল সেই মেয়েটি।
স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে পি.সি. সরকারের (সিনিয়র) ম্যাজিকের টিমে "জাদুকন্যা" হয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন জাপানে। তারপর কলকাতায় ফিরেই সোজা সিনেমায়। আরতি থেকে অঞ্জনা, জার্নিটা খুব সহজ ছিল না।
কোচবিহারের রাজকুমারী গায়ত্রী দেবী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ পর্যন্ত সবাই নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বারে বারে ফিরে এসেছেন তাদের নিজের জেলা কোচবিহারে। কিন্তু আরতি থেকে অঞ্জনা হয়ে কোন অভিমানে বিভূতিকন্যা প্রকাশ্যে আর কোনদিন ফিরে আসেনি কোচবিহারে, সে কাহিনী রহস্যাবৃতই থেকে গেল। এমনকি তাঁর নিজের স্কুল সুনীতি একাডেমীর শতবর্ষ (১৯৮১) উদযাপনের বর্ণময় অনুষ্ঠানেও তিনি অনুপস্থিত থেকে গেছেন। ২০০৬ সালে তার স্কুলের ১২৫ বর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠানেও তিনি যোগ দিতে কোচবিহারে আসেননি।
তাই এ প্রজন্মের কোচবিহারের যুব সমাজের কাছে নিতান্তই একটি অপরিচিত নাম অঞ্জনা ভৌমিক।
আমার চার দশকের সাংবাদিকতার জীবনে কোনদিন তার সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি। তাই প্রশ্নটা অধরাই থেকে গেল।
আজকের সেলিব্রেটি রাজনীতির "গান স্যালুটের" যুগেও এই সফল নায়িকার ভাগ্যে জোটেনি সরকারি অথবা তেমন কোন বেসরকারি পুরস্কার! উদার কলকাতা, বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণভূমি কলকাতার বিদগ্ধ চলচ্চিত্র প্রেমীরাও বেমালুম ভুলে গেছেন, বাংলা ছবির এই সফল মোহময়ী নায়িকার কথা। একি শুধুই উন্নাসিকতা নাকি বঞ্চনা অথবা অবহেলা- তার সঠিক জবাব কোথায় খুঁজে পাবো তা জানিনা।
অচিন দেশে ভালো থাকবেন "অঞ্জনা" চিরকাল - ঈশ্বরের কাছে এই কামনা করি।