একটি ছোট কাঠের আলমারির আঁধার থেকে একদিন বেরিয়ে এসেছিলো এক আলোর উৎস। মলিন মলাটের সেই পুরনো অ্যালবামের মত বইটির নাম 'শারদ অর্ঘ্য।' প্রকাশক এইচ এম ভি ও কলম্বিয়া। আমার কাছে সে ছিল এক 'আবিষ্কার।'
আমাদের বাড়িতে যে পড়ুয়া মানুষ গিজ গিজ করত এমন নয়। হ্যাঁ, বাবা ইছাপুর রাইফেল ফ্যাক্টরির লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়ত৷ কিন্তু বই কিনতে দেখিনি৷ বই যা কেনা হত আমার আবদারে। কিন্তু আমাদের তখনকার যৌথ পরিবারের ওই কাঠের আলমারিতে গাদা গাদা 'শুকতারা,' 'বেতার জগৎ' ও 'শারদ অর্ঘ্য' কী করে জমা হয়েছিল জানিনা। অন্তত তখন সে কৌতুহল হয়নি।
আমাদের শৈশব ও কৈশোরে রেডিও এবং কালো গোল চাকতির মধ্যে ধরা থাকতো গানের ভুবন। সেই চাকতির নাম রেকর্ড। রেডিও খুব ছোটবেলা থেকে দেখলেও রেকর্ড দেখি আমার এক তুতো দাদার বিয়েতে উপহার পাওয়া ফিলিপসের রেকর্ড প্লেয়ারের সূত্রে৷ ছোট রেকর্ডে দুটি বা চারটি করে গান থাকতো। বড় রেকর্ডে থাকতো অনেক গান৷ গ্রামোফোনে সেই রেকর্ড চালিয়ে দিলেই ডানা মেলত গানের নীলকন্ঠ পাখি। বাংলায় অনেক বিখ্যাত রেকর্ড কোম্পানি ছিল। কলম্বিয়া মেগাফোন, ইনরেকো, হিন্দুস্তান রেকর্ডস। তবে সব থেকে খ্যাতি ছিল এইচ এম ভির। 'হিজ মাস্টার্স ভয়েস।' যদিও আমার আবিষ্কার করা এইচ এম ভি-কলম্বিয়ার 'শারদ অর্ঘ্য'গুলি কিন্তু ওই রেকর্ড প্লেয়ার আসার বহু আগের।
একটু 'শারদ অর্ঘ্য'র ইতিহাসের দিকে চোখ বোলানো যাক। গ্রামোফোন কোম্পানি পুজোর গান বের করতে শুরু করে ১৯১৪ সাল থেকে। কিন্তু পুজোয় প্রকাশিত গান নিয়ে বই প্রকাশ নাকি শুরু হয় ১৯৩০ সালে। তখন নাম ছিল 'পুজোর গান।' পরে তার নাম বদল হয়ে 'শারদ অর্ঘ্য' হয়। এই বিষয়ে দুটি তথ্য পাচ্ছি। কেউ বলছেন ১৯৫৬ থেকে নামকরণ হয় 'শারদ অর্ঘ্য,' কেউ বলছেন ১৯৬০ সালে। আর শেষ 'শারদ অর্ঘ্য' সম্ভবত ১৯৮৮ সালে প্রকাশ পায়। সে এক সন্ধিক্ষণ। তখন রেকর্ড থেকে ক্যাসেটের জগতে প্রবেশ করছে গানের দুনিয়া।
আমার এই লেখার সঙ্গে ইতিহাসের দিনক্ষণের তেমন সম্পর্ক নেই। আমি বলতে এসেছি অন্য কথা। গানের ভুবনের সঙ্গে পরিচয়ের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা। সদ্য কৈশোর থেকে প্রাক যৌবনকাল পর্যন্ত যত সঙ্গীত শিল্পীর সঙ্গে পরিচয়, তার সবটাই সেই শারদ অর্ঘ্যেই।
মনে আছে এইচ এম ভি 'শারদ অর্ঘ্য' তার প্রচ্ছদ সাজাতো ঢাকি, কাশফুল ইত্যাদি দিয়ে৷ মা দুর্গার মুখচ্ছবিও সম্ভবত দেখেছি, ভুলও হতে পারে। সেই শারদ অর্ঘ্যেই প্রথম দেখেছলাম চণ্ডীদাস মালের ছবি। প্রথম পরিচয় 'পুরাতনী' ও 'আগমনী' শব্দ দুটির সঙ্গে। গায়কের ছবির সঙ্গে থাকতো গানের বাণীও৷ 'কথা ও সুর: প্রচলিত', এই লব্জের সঙ্গেও সম্ভবত প্রথম পরিচয় চণ্ডীদাস মালের ছবি ও গানের বাণীর সূত্রেই। সাংবাদিক জীবনে একবার বাংলায় লক্ষ্মী বিষয়ক গান নিয়ে সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম চণ্ডীদাস মালের। বাড়ি সম্ভবত বালি বা উত্তরপাড়ায় ছিল৷ উনি যখন এসে বসলেন, যেন এইচ এম ভির শারদ অর্ঘ্যের পাতা থেকে বেরিয়ে এসে বসলেন। সে কথা তাঁকে বলতেই একচোট হেসেছিলেন তিনি।
ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য আমার অন্যতম প্রিয় গায়ক। 'এই ঝির ঝির ঝির বাতাসে / এই গান ভেসে আসে / এই ঝির ঝির ঝির বাতাসে / এই গান ভেসে আসে / সেই সুরে সুরে মন / নাচে উল্লাসে।' আহা কী গান! ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের 'এলি গো কৈলাশেশ্বরী আমার অন্নপূর্ণ' গানটি পুজোর মুখে খুব ভালো লাগলেও 'এই ঝির ঝির ঝির বাতাসে / এই গান ভেসে আসে' আমার চিরকালের প্রিয় গান।৷ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের ওই ভরন্ত গালের ছবি ওই শারদ অর্ঘেই প্রথম দেখি।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছবিও প্রথম দেখি শারদ অর্ঘ্যে। তখনও তাঁর গাওয়া কোনও গানই শুনিনি। যখন শুনলাম, স্তব্ধ হয়ে শুনেছি। সেই মুগ্ধতা আজও কাটেনি। পরে তাঁর গান সামনে বসে শুনেছি। একটা স্মৃতি না বলে পারছি না। সেই তাঁর গান সামনা সামনি শেষ শোনা। ইছাপুরের এ টি এস অডিটোরিয়ামে গাইতে এসেছেন। তখন বয়স মাঝে মাঝে ছোবল বসাচ্ছে তাঁর কন্ঠে। কী একটা গান গাইতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্য গলা ভাঙল। বেশ কিছু শ্রোতা আসন থেকে চেঁচিয়ে বলল,''অনেক বয়েস হয়েছে, আর নাই গাইলেন। আপনার ভাঙা গলা শুনতে চাই না।" গান শেষে কয়েক মুহূর্ত মুখ নীচু করে চুপ করে রইলেন। তার পরেই সেই জলদ গভীর স্বরে গান ধরলেন, 'শ্রাবণের গগনের গায় / বিদ্যুৎ চমকিয়া যায় / ক্ষণে ক্ষণে....।' সেই গানে অডিটোরিয়ামের ভিতর যেন সত্যি শ্রাবণের বিদ্যুৎ চমকে উঠলো।
সাংবাদিক জীবনে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। শ্যামল গুপ্তকে অতিক্রম করে কী ভাবে যে আনন্দবাজারের জন্য সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সেও এক গল্প। এই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গেও প্রথম পরিচয় ওই শারদ অর্ঘ্যের পাতায়৷ যে ভাবে পরিচয় মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, বনশ্রী সেনগুপ্ত, নির্মলা মিশ্রদের সঙ্গে। পরে সাংবাদিক জীবনে 'আকাশ বাংলা'র এক অনুষ্ঠানে বনশ্রী সেনগুপ্ত এবং নির্মলা মিশ্রকে মুখোমুখি আড্ডায় বসানোর সময় বলেছিলাম সেই শারদ অর্ঘ্যে দেখার কথা। নির্মলা মিশ্র ইয়ার্কি করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সেই কম বয়েসে কেমন দেখতে ছিলাম বল দিকি?
আর দু এক জনের কথা বলে এই লেখা শেষ করি। সম্ভবত তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, পিন্টু ভট্টাচার্য, সুবীর সেনের ছবি ওই শারদ অর্ঘ্যেই প্রথম দেখি। তাঁরা সেই চেহারাতেই আমার চোখে লেগে আছেন। তাঁদের গানের মুগ্ধ শ্রোতা হলেও ওই শারদ অর্ঘ্যের বাইরে কোনও দিন তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়নি। যেমন কখনও দেখিনি মিন্টু দাশগুপ্তকে। প্যারডি বলে কোনও গান হয়, সেই গানের বিখ্যাত শিল্পীর নাম মিন্টু দাশগুপ্ত, এ সব আমাকে শিখিয়েছিল এউচ এম ভির 'শারদ অর্ঘ্য।' এখনও পুজো এলে সেই পুরনো 'শারদ অর্ঘ্য'গুলো যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে মনে এখনও তার পাতা উল্টাই।