শৈশব থেকেই মফস্বলের আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা। গ্রাম-মফস্বলে থাকলে পাড়া ও এলাকার সবার সঙ্গে সদ্ভাব রাখাটা প্রকৃত স্বভাবে পরিণত হয়। আমার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমাদের পুজো শুরু হত চাঁদা তোলা। পাড়ার বাড়ি বাড়ি বেরোতাম চাঁদা তুলতে। সেই সময় কোনও থিম বা অতিশৈল্পিক কারুকার্য থাকত না মণ্ডপে। তবে প্রতিমার ডাকের সাজ ছিল বাধ্যতামূলক। প্রতিমার মুখমণ্ডল দেখে মনে হত, যেন কোনও তেজ ও শক্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
তখন ঋতুরও এত খামখেয়ালিপনা ছিল না। শরৎকালে যেমন আবহাওয়া থাকা দরকার, অর্থাৎ পেঁজা তুলোর মেঘ, কাশবন দেখা যেত। দুর্গাপুজোর আগমনীর সুর বয়ে নিয়ে আসত যেন সেই সব প্রাকৃতিক দৃশ্য। পুজো যত কাছে আসত ততই মন উতলা হয়ে উঠত কবে স্কুল ছুটি পড়বে, সেটা ভেবে। স্কুলের ছুটি ঘোষণা, খবরের কাগজের পাতাজুড়ে জুতোর বিজ্ঞাপন ও টিফিনের টাকা জমিয়ে আনন্দমেলা ও সন্দেশ পত্রিকার পুজাবার্ষীকী কেনার তাড়নাও থাকত খুব।
পুজোর চার দিন বাড়িতে কী রান্না হবে তা নিয়েও কৌতুহল থাকত খুব। আজ কি পাঁঠার মাংস নাকি সেই বড়ো কাতলা মাছের কালিয়া বা টিভির অনুষ্ঠান থেকে শিখে খাতায় লিখে রাখা পোলাও? এইসব ভাবনা চলত মাথায়। পোশাকের বিপুল সম্ভার না থাকার কোনও আক্ষেপ ছিল না। সপ্তমীর নির্দিষ্ট টি শার্ট ও প্যান্ট নবমীতে পরেও দিব্যি কেটে যেত।
পুজোর চারদিনের বিশেষ আকর্ষণ ছিল রোলক্যাপ ফাটানো, খেলনা পিস্তল কেনা, কালি পটকা, দোদমা, সেভেন সাউন্ড, বুড়িমার চকলেট ফাটানো। কালিপটকার ঝোলা নিয়ে জ্বলন্ত ধুপকাঠির সংযোগে, শাস্তি দেওয়া অঙ্ক স্যারের দেওয়ালে, খেলায় অংশ নিতে প্রত্যাখ্যান করা ক্যাপ্টেনের বাগানে দেদার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রতিশোধও নিতাম।
হাতখরচ বাবদ দৈনিক ৫০ টাকা দেওয়া হত বাড়ি থেকে। খরচ হতো ঘুগনি, লাল রঙের কষা ডিম, আর এলাকার প্রসিদ্ধ 'পোদ্দার ক্যাটেরার' দ্বারা পরিচালিত সাময়িক রেস্তোরাঁয়।
দশমীর রাতে প্রায় সব প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া হত। ঢাকের তালে, কাঁসরের তীব্র আওয়াজে ট্রলির ওপরে প্রতিমার সামনে যখন ধুনোর ধোঁয়া ভেসে উঠত, স্পষ্ট দেখতে পেতাম দৈনিক নিয়মের মধ্যে থাকা, সেই একই ডিমের ঝোল ভাত, সেই সকাল সন্ধে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার ছুঁচো দৌড়। মনে হতো দীঘির জলে ঝাঁপ দিয়ে গণেশ ঠাকুরের সঙ্গে যদি কৈলাসে পালানো যেত!
তখন যেন মুচড়ে উঠত ভিতরটা, ঠিক মামার-বাড়ি থেকে ফেরার সময় মায়ের যেমন হয়।
প্রতিবেদক - সরকারি কর্মী