ফিরে তাকানোটা আসলে আমাদের অনেকেরই স্বভাব। প্রেমিকাকে ট্রেনের জানলার ধারে দখল করা সিটটায় বসিয়ে দিয়ে সেই প্রেমিক যারপরনাই আহ্লাদিত হয়ে নিজে ট্রেন থেকে নেমে এল আর প্রেমিকা সেখানে গুছিয়ে বসল। তারপর জানলায় মুখ বাড়িয়ে প্রেমিকা আরও কত কত কথা বলেই চলেছে। প্রেমিক মহোদয় সেসব শুনতে শুনতেই ট্রেনটা ছেড়ে দিল। দুজন দুজনকে হাত নাড়ল আর তারপর প্রেমিক প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতে যেতেও বারবার পিছনে দেখছে। তখন তার প্রেমিকা তার দৃষ্টি থেকে সরে গেছে কিন্তু তবুও প্রেমিক ভায়া ফিরে ফিরে ট্রেনটা দেখেই চলেছে। ট্রেনের লেজটা চলে গেলেও তবুও ফিরে ফিরে সে দেখেই চলেছে আর ভেবে চলেছে এরকমভাবেই তাকে কতবার ছেড়ে দেওয়া আর কতবার কাছে পাওয়ার দিনগুলো। এগুলো আর তেমন কিছু নয়, ওই ফিরে ফিরে দেখা আর ফিরে ফিরে ভাবা। এসব তো হয়ই। আর বড় হয়ে গেলে কোনও বিশেষ ঘটনাপ্রবাহ ফিরে ফিরে দেখা আর ভাবা এক ধরনের রোমান্টিকতা। মানে কিছুটা যেন ভাবালুতা। এরকম না হলে মানুষ নাকি ! ওই খেলাম দেলাম আর ডুগডুগি বাজিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলাম, ওসব মানুষের লক্ষণ নয়, ওসব শীর্ণ মানসিকতা। ওই মানসিকতায় প্রাণ নেই, ঘ্রাণ নেই, টান নেই মানে জীবনের ছুরিতেও শান নেই। জীবন মানে একটা শান দেওয়া ব্যাপার। সবসময় চকচক করবে। অতীত এসে ঝলসাবে, বর্তমান এসে ছলকাবে আর ভবিষ্যৎ এসে অনাগতর গল্প বলবে।
তব না হুয়া জিন্দেগি। কোই জানা নহি, কোই সমঝা নেহি।
বেমতলব বলা নেই, কওয়া নেই এইসব আমি হঠাৎ বলছিই বা কেন! আশ্চর্য তো ! তাও ঠিক। নিজের কাছে নিজেরই আশ্চর্য ঠেকছে। এই বলছিলাম সামনে কলকাতার পৌরসভার ভোট আসছে বোধহয় তাই। মাঝেমাঝেই রাস্তায় আমি দেওয়াল আর ফেস্টুনের মাঝে নিজেকে কেমন ঘিরে ফেলছি। সরি ভুল হল, দেওয়াল আর রঙচঙে ফ্লেক্স আমাকে ঘিরে ফেলছে। আমি পিছন ফিরে দেখছি সেই সব দিনের ভোট পূর্ব দিনগুলোকে। ওই যে বলছিলাম, অতীত ঝলসাবে, বর্তমান ছলকাবে আর ভবিষ্যৎ ঠিকরাবে তবে না ভোটের রঙ খুলবে। জীবনের রঙও। সবটাই রঙের খেলা। সে খেলা হয়েছে, সে খেলা হয়, আর সে খেলা হবে।
সেই অতীত বেলায় হুমড়ি খেয়ে দেখতাম, পুরোনো খবরের কাগজে আলতা বা লাল রঙ দিয়ে বড় দাদারা বা কাকুর বয়সী যারা তারা কেমন তুলি টানছে। অমুককে তমুক চিহ্নে ভোট দিন বা এই অরাজকতা মানছি না, মানব না। আমাদের দাবি মানতে হবে, মানতে হবে। তখন আমার দাবি কী ছিল সরকারের প্রতি, তা মনে নেই। শুধু মনে আছে, পাড়ার দাদাদের কাছে আমার দাবি- টিমে আমার চান্স চাই, চান্স চাই। সেসব লিখিনি, মুখ ফুটে বলেছি মাত্র। কিন্তু ভোটে শুধু বললে হয় না, লিখে দিতে হয়, সেঁটে দিতে হয়। এখন সেসব খুব মনে পড়ে। রাতের অন্ধকারে ছেলেগুলো সাইকেলে বেরিয়ে পড়ল, গাঁ ও শহরে। হাতের মাঝে পুরোনো কাগজে লেখা দাবি দাওয়া, অঙ্গীকার আর ভোট চেয়ে লেখা পোস্টার। ঝপাঝপ আঠা দিয়ে সেঁটে দেওয়া হল দেওয়ালে আর সকালবেলায় কতো মানুষের চোখ গেল আটকে। সেই লেখায় কার কী প্রভাব পড়ল জানি না। কিন্তু ভোট যে দরগোড়ায় তা জানান দিল দুনিয়া। আর তুলির টানে কার্টুনে কিছু চরিত্র যেন দেওয়ালে দেওয়ালে এক্কেবারে প্রতিবিম্ব। দেখে হাসি পায় আবার মনের ভিতরে নাড়া দেয়।
তখন টিভির মৌতাত নেই, প্যানেল ডিসকাশন বলে কোনও হল্লার আসর নেই, শুধু আছে দেওয়াল আর দেওয়ালের লিখন। এক দেওয়ালে হাতুড়ির ঠুকঠুক আর তারার ঝলকানি তো আরেক দেওয়ালে ধানের শীষের ফুটন্ত সৌরভ। আর একটু এগোলেই গাই বাছুর এবং তা বদলাতে বদলাতে জোড়া বলদ আর শেষ পর্যন্ত হাতের পাঞ্জা ছাপে দেওয়াল যেন ঘিরে ফেলল। কাঁচা হাতে লেখা দলের দাবি অথবা তিলতিল সৌন্দর্য দিয়ে তুলির টানে অপূর্ব সব গ্ৰাফিটি। মনে পড়ে, বড্ড মনে পড়ে।
এক সন্ধ্যায় টিউশন ফিরতে বড় দেরি হয়ে গেছে। সাইকেল চলছে আমার তীর গতিতে। স্কুল বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, দেখি দেওয়াল ঘিরে হালকা জটলা। চোখ ফিরিয়ে দেখি দেওয়ালে চলছে আঁকিবুকি। এক অচেনা দাদা বলল- দাঁড়াতো একবার সাইকেলটা একটু দে। কিছুটা ভয়ে আর সম্ভ্রমে দাঁড়িয়ে পড়তেই টপ করে আমার সাইকেলের ক্যারিয়ারে দাঁড়িয়েই উঁচু দেওয়ালে ভোট চিহ্ন আঁকতে লাগল ওই দাদা। তা দেখে আমি তো হাঁ। তখন আমি দাদার ব্যলান্স দেখব না তার তুলির টান দেখব বুঝতে পারছি না। পাশে একজনের ঘাড়ে চেপে ( জায়গাটা কেমন গর্ত মতো) আর একজন দাদা দেওয়ালে বুরুশ চালাচ্ছে। আমি তো 'থ'। এদিকে পেট আমার ক্ষিদেতে তখন চুঁইচুঁই। ওদের দলীয় ছবি আঁকা শেষ হল আর এক দাদা বললো- কী রে ক্ষিদে পেয়েছে ? কী করে ওরা বুঝল জানি না। আমার হাতে দুটো রুটি আর দুটো গুড় গুঁজে দিয়ে বললো- খেতে খেতে চলে যা। আমি তারপর খাচ্ছিলাম আর যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম- দেশ কি তাহলে বদলে যাবে এদের লেখায় আর সাধনায়! ওদের আঁকা ছবিগুলো তখন হয়তো ফিরে ফিরে আমাকেই দেখছিলো আর আমি ফিরে ফিরে ওদের দেখছিলাম।
সেও তো এক ফিরে দেখাই।
তখন এতো ফ্লুরোসেন্ট আসেনি। গোলা রঙেই মূলতঃ দেওয়াল সাজত। সব পার্টিরই দরদী কর্মীরা ভোটের দাবি আর আবদার নিয়ে জি জান লাগিয়ে পোস্টার মারত। ভাড়াটে লিখিয়ে নেই বললেই চলে। কেউ ওদের বলত- ওরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে আবার কেউ কেউ বলত- ওদের উপর ভরসা করা যায়। এই চাপান উতরের ওরা তোয়াক্কা করতো না। লম্বা কাপড় টান টান করে পেতে তাতে তাদের তুলির টান চলতো আর রাস্তার মোড়ে ঘাড়ের উপর চেপে বা বাঁশের সিঁড়িতে ব্যালান্স করে ওরা কাপড়ের ফেস্টুন লাগাত। তাতে এক্কেবারে মাপে মাপে বাঁধা অক্ষর ছিল ওদের আর ছিল রঙিন তুলিতে মনের ইচ্ছার প্রতিধ্বনি। অপরূপ তার শিল্প সুষমা। দেখে চোখ জুড়ায়। আসলে তখন ফ্লেক্স আসেনি। মেশিনের বালাই ছিল না। তখন যুগটা কাপড়ের।
থান কেটে তুলির টান।
এখন ফ্লেক্সের যুগ। এখন ডিজাইনখানায় গিয়ে ডিজাইনারের ঘাড়ের উপর বসে ভালোবেসে বা হম্বিতম্বি করে, কিছু পয়সার বিনিময়ে রঙবাহারি দলের বাণী ছেপে, ছবি সাজিয়ে পাড়ায় টাঙিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ। সেসব ছিল না তখন। ছিল সূক্ষ্ম হাতের সূক্ষ্ম তুলির বিমূর্ত টান। সে টানের অঙ্গীকারে তারা ভাসত। এখন ভাসে না, সে কথা আমি বলি না। তবে যন্ত্রের টান আর পটু হাতের তুলির টানে প্রাণের স্পর্শ তো আলাদাই। ভোটে জিতলেও আলাদা, হারলেও আলাদা। ওই আলাদা টানের দিকে মনের টান। একটু বেশি। ওটুকু না থাকলে চলে না।
মন আর স্মৃতি যে বড় বালাই। সেসব ছেড়ে কোথায় আর পালাই !
আমার মনে পড়ে ওরা খুব এক্সরে প্লেট খুঁজত তখন। এক্সরে প্লেট কে আর রেখে দেয় ? হাত ভেঙেছে, হাত জুড়েছে আর এক্স রে প্লেটের ঠাঁই হয়েছে আস্তাকুঁড়ে। কিন্তু ওদের কাছে দেখতাম এক্সরে প্লেট গোছানো আছে বড় যত্নে। খুব ঔৎসুক্য হল আমার- কি হয় ওই প্লেট দিয়ে। তা দেখতে একবার জুড়ে গেলাম ওদের সাথে, এক্সরে প্লেটের রহস্য সন্ধানে। দেখি খুব যত্ন করে ওরা সেই প্লেটের উপর ছুরি ঘষছে। ব্যাপার টা কী ? আসলে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে ওরা ওদের দলের প্রতীক আঁকছে তাতে। প্রতীক আঁকা শেষ হল। এক্সরে প্লেটে খোদাই করে ফুটে উঠল ওদের দলের চিহ্ন। তারপর ওরা দল ভাগ করে এক একটা প্লেট নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ছোটো ছোটো দেওয়াল খুঁজতে। সেই দেওয়ালে হাত দিয়ে চেপে ধরা হল এক্সরে প্লেট আর আরেকজন সেই ছুরি দিয়ে প্লেটে করে দেওয়া খাঁজে ঝপাঝপ নীল গোলা রঙ পড়ল। তারপর আস্তে করে দেওয়াল থেকে সরিয়ে নেওয়া হল প্লেটটি আর দেওয়ালে ফুটে উঠল রঙিন প্রতীক চিহ্ন। তার পাশে প্লেট থেকেই রঙ করা প্রতীক ছেপে গেল দেওয়ালে। এই চিহ্নে ভোট দিন। মুহুর্তে মুহূর্তে কতো দেওয়াল ভরে উঠল এক্সরে প্লেটের ছাঁচ মারফৎ। ওদের চোখেমুখে তখন ফুর্তির ছাঁচ। তাতে দপদপ করছে তাদের বিশ্বাসের আগুনে তপ্ত হওয়ার আঁচও। ভুলি কি করে? ভুলিনি। তাই ফিরেফিরে ভেবে যাওয়া সেই ছেলেগুলোর অপূর্ব লিখন। সে লেখার ধরণ বদলে গেছে আজ। তবে তাদের কজনের প্রত্যাশা আর ভাগ্যের লিখন বদলেছে তা আমি জানি না।
দেওয়ালের লিখন আজও আছে। কত তার রঙ, দলীয় ও ভাড়াটে শিল্পীরা ভরে তোলে দেওয়ালের পর দেওয়াল। বহু ভাড়াটে গুণী শিল্পী এ দলের প্রতীকের আহ্বান দেওয়ালে নিপুণ হাতে এঁকে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রতীক আঁকতে অন্য দেওয়ালের সামনে তুলি চালায়। তারা বলে পেটের দায়। তাদের নিখুঁত হাতে ফ্লুরোসেন্ট রঙে, লালে, সবুজে, গেরুয়ায় ভরে যায় সাদা দেওয়াল চত্বর। সে লেখা চোখ টানে বড়। শুধু বদলে যায় ধীরে ধীরে সাদা-কালোর ইতিহাস। ঢাউস ঢাউস কাট আউটে শহর ভরে যায়। সেই কাট আউটের নেতার মুখ স্মিত হাসি দিয়ে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে। ধীরে ধীরে কেমন ফিকে হতে থাকে সেসব দিনের রাতজাগা দেওয়ালের লিখনের দিনগুলো। তবু যেন জেগে থাকে সেই দেওয়ালের চিহ্নগুলো। ওরা হাত বাড়িয়ে এখনও ডাকে আয় আয়। আমার মন ফিরে ফিরে ভেবে যায়। ভেবেই যায়।
প্রেমিক প্রেমিকার কাহিনি দিয়ে শুরু করেছিলাম বিঁতে হুয়ে দিনো কি কাহানী। তাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল তারপর। আজ হঠাৎ এক প্লাটফর্মে দেখি ওরা দুই নয়, এখন তিন। স্বামী স্ত্রী এসেছে ছেলেকে ট্রেনে চাপিয়ে দিতে। ছেলে তার নিজস্ব সিটে গিয়ে বসল। তার মা বাবা জানলার ধারে ছেলের সাথে বাকি কী কথা সেরে নিল তা আমি শুনিনি। শুধু দেখলাম, তারপর ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল। তারা হাত নাড়ল আর ছেলের মা বাবা ফিরেফিরে দেখতে লাগলো ট্রেনের শেষ বগিটুকুও। তারা হাঁটতে থাকে আর বারবার ফিরেফিরে দেখতে থাকে তার ছেলের ওই চলে যাওয়া। তাদের মনের দেওয়ালে তখন কতো স্মৃতিই না খেলে খেলে ফিরে ফিরে আসে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ফিরে যায় বাড়ির দিকে। তারাও বাড়ি ফিরছে আর আমিও ফেলে আসা স্মৃতির দেওয়ালগুলো পড়তে পড়তে যাচ্ছি।
চারিদিকে দেওয়াল জুড়ে কত রঙ, কত প্রতিশ্রুতি। চারিদিকে স্লোগানে স্লোগানে মুখর। দেওয়ালে রঙ বেরঙের ঝকঝকে লেখাগুলো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সেদিনের আলতো হাতের ছোঁয়ায় গোলা রঙগুলোর পোঁচ উঠে তাতে আধুনিকতার রঙ লেগেছে। দেওয়াল সেসব দেখতে পাচ্ছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত দেওয়াল লেখার ধরণধারণে বিশাল বদল এসেছে, মানসিকতায় অর্থের প্রাবল্য এসেছে, ঔজ্জ্বল্য এখন মারাত্মক, তবু বদলে দেওয়ার গল্প দেওয়ালে লিখলেই সবাই যে এখন সমাজ বদলে বিশ্বাস করে না, তা প্রতিটি দেওয়াল শুনতে পাচ্ছে।
আসলে দেওয়ালেরও যে কান আছে!