অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কোনও বড় সমস্যাকে যে পদানত করা যায়, তার প্রমাণ এবারের পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত নির্বাচন।কোচবিহারে বিজেপি এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে পিঙ্কি বর্মন নামে একজন প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছেন যিনি আসলে একজন বৃহন্নলা।
জেলা পরিষদের ৯ নম্বর আসনে বিজেপির তরফে প্রার্থী করা হয়েছে বৈরাগীরহাটের বৃহন্নলা সমাজের কর্ণধার পিংকি বর্মনকে। পিংকি মাথাভাঙ্গা মহকুমা শাসকের দপ্তরে মনোনয়নপত্র জমা দিযেছেন। ওই আসনে গতবার জিতেছিলেন তৃণমূলের শুক্লা রায় বিশ্বাস। এবারও তাঁকে তৃণমূল ওই আসনে প্রার্থী করেছে। শুক্লাদেবীর তুলনায় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ পিংকি কিন্তু জেতার ব্যাপারে ১০০ শতাংশ আশাবাদী। তাঁর কথায়, ‘ভিক্ষাবৃত্তি করে সারাবছর মানুষের সেবা করি। বৃহত্তর পরিসরে সেবা করার লক্ষ্যেই ভোটের আঙিনায় পা রাখলাম। মানুষের আশীর্বাদে ভোটে আমিই জিতব।’
বিজেপির কোচবিহার জেলা সহ সভাপতি মনোজ ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘সেবামূলক কাজের জন্য পিংকি এলাকায় যথেষ্ট পরিচিত। উনি বিজেপির মতাদর্শে বিশ্বাসী। ভোটে জিতে মানুষের সেবা করার সুযোগ করে দিতেই দল তাঁকে প্রার্থী করেছে। তিনি জিতবেন বলে আমরা আশাবাদী।
এবারের নির্বাচনের শুরু থেকেই হিংসা ও গোলমালের ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে একঝলক টাটকা বাতাস নিয়ে এসেছে পিঙ্কির প্রার্থী হওয়া। পিংকি অবশ্য দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ নন। এই সমাজে পিংকি অন্যদের মতোই সাধারণ জীবনযাপন করেন। তবে এর পাশাপাশি সমাজের জন্য কিছু করার কথা সব সময়ই ভেবেছেন পিংকি। এরপরে, পিংকি বুঝতে পেরেছিলেন যে আপনি খুব বড় পরিসরে কিছু করতে চাইলে রাজনৈতিক পরিচয় দরকারি। তাই রাজনীতিতে যোগ দেন। বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর পিংকিও প্রার্থী হওয়ার সুযোগ পান। ইন্ডিয়া টুডের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় পিঙ্কি বলেন, "আমি জানি না অন্য কোনো দলের ট্রান্সজেন্ডার প্রার্থী আছে কি না। আমি শুধু জানি, বিশ্বের সবচেয়ে বড় দল বিজেপি আমাকে মনোনয়ন দিয়েছে। তাই আমি খুব গর্বিত খুব খুশি।.'
পিঙ্কির অতীত অবশ্য সহজ ছিল না। পিংকির বাবা-মা তাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, তাঁর দাদারাও তাঁকে মেনে নেননি। শুরু থেকে একাই লড়েছেন পিংকি। একান্ত আলাপচারিতায় পিংকি বলেন, "আমি শিক্ষার সুযোগ পাইনি। এই সমাজ আমাকে গ্রহণ করে না। আমি যা জানি এবং যা শিখেছি তা জীবনের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। আমার পরিচয় জানার পর সমাজ দেখেনি। আমি ভালো আছি। আমাকে অনেক অপমান ও মারধর সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু সমাজ যাই করুক, আমি প্রতিশোধ নিতে চাইনি। বরং আমি সমাজের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলাম।"
আপনি জিতলে কি করবেন? পিংকি কিছু না ভেবেই উত্তর দিল, "আমি অনেক কাজ করব। শুধু ধনীদের জন্য নয়, সমাজের নারী-পুরুষ সবার জন্যই কাজ করতে চাই।'' কী কাজ? পিংকি বলেন, "সমাজের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। দারিদ্র্য। আমি আমার স্বল্প সামর্থ্যের মধ্যে চেষ্টা করব যাতে মানুষ খাদ্য ও বাসস্থান পায়, পরার জন্য কাপড় পায়, আমি লেখাপড়া করতে পারিনি। এখন মনে হচ্ছে লেখাপড়া ভালো হবে। আমি চাই সবাই শিক্ষা লাভ করুক।' একটি স্কুল খোলারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান পিংকি।
পিংকি বৃদ্ধদের জন্য একটি আশ্রম তৈরি করেছেন। পিংকির নিজের ভাষায়, "বাবা-মায়ের আশ্রম।" পাশেই তৈরি হচ্ছে বিষ্ণু মন্দির। পিংকি বলেন, “আমি এসব করতে ভালোবাসি। মনসার গান বা কীর্তন। আমি আশ্রমের জন্য টাকা জোগাড় করতে, মন্দির তৈরির জন্য দ্বারে দ্বারে মানুষের কাছে ভিক্ষা করেছি।''
দশ কিলোমিটার দূরে অশোকবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিংকি জন্মের পরপরই মাকে হারান। পিঙ্কির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে পিংকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়। এখন পিঙ্কির প্রধান কাজ ঘরে ঘরে বাচ্চা আছে কিনা তা খুঁজে বের করা। সেই সূত্রে আয়। তবে 'মনসার গান'-এর গায়িকা হিসেবে ওই এলাকায় তার সুনাম রয়েছে। কোচবিহারে গানটিকে স্থানীয় ভাষায় 'বিশাহারা' বলা হয়। সেই সময়ে, তার ভোটাধিকার নেই। ২০০১ সাল থেকে, তারা সবাই তাদের ভোটাধিকারের জন্য প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবাদে যন্তর মন্তরে গিয়েছিলেন তিনি। ভোটার আইডি কার্ডও পেয়েছেন।