মাত্র দশ বছর বয়সে বালিকা ভবতারিণীর ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হয়ে। বালিকা ভবতারিণী, তখন জানতও না কোন মহান মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে সে। সেসময় ভবতারিণী নিতান্তই সামান্যা। বৌদি কাদম্বরী দেবী চলে যাওয়ার পর গভীর শোকে মর্মাহত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেসময় ভবতারিণী নাবালিকা। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রবিঠাকুরের হাত ধরে তিনি হয়ে ওঠেন মৃণালিনী।
রবীন্দ্রনাথের বিবাহ নিয়ে একটি গল্প আছে। লেখিকা চিত্রা দেবের 'ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল' বইতে রবীন্দ্রনাথ ও বালিকা ভবতারিণীর বিবাহ বাসরের একটি মুহূর্ত তুলে ধরেন। জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজের বিয়ের প্রসঙ্গে বলতেন "আমার বিয়ের কোনও গল্প নেই। আমার বিয়ে যা-তা করে হয়েছিল।"
কিন্তু প্রথমদিকে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছিল ঘটা করে। স্নেহের রবির জন্য পাত্রী খুঁজতে তৈরি হয়েছিল কমিটি, যাঁর সদস্য ছিলেন--- জ্ঞানদানন্দিনী, কাদম্বরী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও। যশোহর থেকে দক্ষিণডিহি, চেঙ্গুটিয়া সমস্ত গ্রাম খুঁজে ফেললেও মনের মতো রবির সুযোগ্যা পাত্রী খুঁজেই পাচ্ছিলেন না কেউ। শেষে ঠাকুর স্টেটের কর্মচারী বেণীমাধব রায়ের বড় মেয়ে ভবতারিণীর সঙ্গে বিয়ে হয় রবীন্দ্রনাথের। জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই হয় যাবতীয় অনুষ্ঠান।
পারিবারিক বেনারসি 'দৌড়দার' জমকালো শাল গায়ে জড়িয়ে বাড়ির পশ্চিমের বারান্দা ঘুরে বিয়ে করতে যান রবীন্দ্রনাথ। কবির বাসর ঘরের এই ঘটনাটি জানা যায় প্রত্যক্ষদর্শী হেমলতার থেকে। তাঁর লেখায়,"বাসরে বসেই রবীন্দ্রনাথ ভাঁড় খেলার বদলে ভাঁড়গুলি সব উল্টে পাল্টে দেয়। তাঁর ছোট কাকিমা ত্রিপুরা সুন্দরী বলে ওঠেন,"ওরে রবি, করছিস কী? এই বুঝি তোর ভাঁড় খেলা"। তাঁর উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন,"জানো না কাকিমা--- সব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আমি ভাঁড়গুলো উল্টে দিচ্ছি।"
এরপর নাকি জড়সড় নববধূ বালিকা ভবতারিণীর দিকে চেয়ে কৌতুক ভরে গানও গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ," আ মরি লাবণ্যময়ী.."। বিবাহের পরপর বালিকা স্ত্রীয়ের সঙ্গে কী নিয়েই বা আলোচনা করবেন ভেবেই কুল পেতেন না তিনি। জানা যায়, প্রথমদিকে বেশ কয়েকদিন তাঁদের মধ্যে কথাও হয়নি। কিন্তু বয়সের সন্ধিক্ষণে শুরু হয় ভবতারিনীর মৃণালিনী হয়ে ওঠার যাত্রা। ঠাকুরবাড়ির আদব কায়দার তালিম নিতেন তিনি। যদিও, কোনও আদবকায়দাই তাঁকে আকৃষ্ঠ করেনি। নিজের জীবনটা সংসারকেই নিমজ্জিত করেন মৃণালিনী।
সহধর্মিণী মৃণালিনীকে লেখা একটি পত্র থেকে জানা যায় সেখানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,"আমাকে সুখী করবার জন্য তুমি বেশি কোনও চেষ্টা করো না-- আন্তরিক ভালোবাসাই যথেষ্ট। অবশ্য আমাতে তোমাতে যদি সকল কাজে যোগ থাকত খুব ভালো লাগত--কিন্তু সে কারও ইচ্ছায়ও নয়।.....সকলেরই স্বতন্ত্র অনুরাগ এবং অধিকারের বিষয় আছে....আমাকে অনাবশ্যক দুঃখ কষ্ট থেকে রক্ষা করলেই সে চেষ্টা আমার পক্ষে বহুমূল্য হবে।"
সহধর্মিণী মৃণালিনীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, স্নেহের প্রকাশ পায়। কিন্তু সেই স্নেহ-ভালবাসার সময়ও দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯০২-এর ২৩ নভেম্বর স্নেহের মৃণালিনীও কবিকে ছেড়ে যান মাঝপথে। জীবনসঙ্গিনীর চলে যাওয়ায় তাঁর জীবনে নতুন করে শোক নেমে আসে।
(সমস্ত ছবি: উইকিপিডিয়া স্ক্রিনশট)