শহরের তাপমাত্রার পারদ আগেই ১১ ডিগ্রিতে নেমেছে । কলকাতায় শীত পড়ে গিয়েছে। সারা বছর প্যাচপ্যাচে গরমের মাঝে মাস খানেকের এই শীত যেন কলকাতাবাসীর কাছে 'পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা' । বড় দিনে প্রায় এসে পড়েছে। শীতের এই সময়টায় তাই প্রতিবছরই মানুষের ভিড়ে গমগম করে নিউমার্কেট চত্বর। কোভিড আবহে এবারও তার অন্যথা হয়নি। কাজের অবসরে অথবা বেড়ানোর এক ফাঁকে নাহুমের কেক কিনবে না বাঙালি,অথবা বাড়িতে নিয়ে যাবে না – এমনটা বোধহয় হয় না ! বড়দিনের প্রাক্কালে তাই নাহুমের সামনে পড়ে গিয়েছে লম্বা লাইন। বড়দিনে কেক খেতেই হবে। তবে নাহুম ছাড়াও কলকাতার নিউ মার্কেট চত্বরে রয়েছে বেশ কিছু কেকের দোকান, যাদের কেক, প্রেস্ট্রি ও ক্রিম রোলের চাহিদা থাকে সারা বছর।
ফ্রুট হোক বা প্লেন প্লাম কেক অথবা নিত্যনতুন পেস্ট্রি। কেক ছাড়া বড়দিন বড়ই বেমানান। আসুন ক্রিসমাসের আগে জেনে নেওয়া যাক কলকাতার বিখ্যাত কিছু কেকের দোকানের খবর।
নাহুম অ্যান্ড সন্স (Nahoum & Sons)
১৯০২ সালে নাহুম ইজরায়েল মর্দখয় (Nahoum Israel Mordecai) নামে এক ইহুদি যুবক কলকাতায় কেকের ব্যবসা শুরু করার কথা ভাবেন। কিন্তু দোকান কেনার টাকা না থাকায় অগত্যা বাড়ি বাড়ি গিয়েই কেক-পাঁউরুটি বিক্রি শুরু করেন নাহুম। অবশেষে ১৯১৬ সালে নিউ মার্কেটে (তৎকালীন হগ মার্কেট) দোকান খোলেন তিনি। সেই থেকে আজও নানা স্বাদের কেক বিক্রি করে চলেছে নাহুম অ্যান্ড সন্স। কেকের পাশাপাশি এদের পাউরুটিও কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। নাহুমের কেক খাওয়া বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন পরম্পরা,অনেক সুখস্মৃতি,আর নষ্টালজিয়া৷নাহুমের সঙ্গে কেবলমাত্র কলকাতার মানুষদের নয় বরং বাঙালির আছে একটা আত্মিক সম্পর্ক৷নাহুমের স্বাদ এবং সাবেকিয়ানা আজও অটুট তিন প্রজন্ম ধরে।
ফ্লুরিস (Flurys)
১৯২৭ সালে সুইস দম্পতি, জোসেফ এবং ফ্রেডা ফ্লুরিজ পার্ক স্ট্রিটে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান খোলেন। নাম দেন ফ্লুরিজ। সেই শুরু। তার পর যত দিন গেছে তত কলেবরে বেড়েছে এই দোকান। এমনকী, উত্তমকুমার এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রথম সারির অভিনেতারাও নাকি প্রায়ই ঢুঁ মারতেন এই রেস্তরাঁয়। আর আজ তো কলকাতার পাশপাশি দেশের অন্যান্য শহরেও ফ্লুরিজের শাখা রয়েছে। এখানকার নানা স্বাদের কেক যতটা জনপ্রিয়, ততটাই মুখরোচক চিকেন প্যাটিসের মতো স্ন্যাক্সও। তাই কোনও এক ছুটির দিন যদি জমিয়ে ব্রেকফাস্ট সারতে মন চাইলে, সপরিবারে ঢুঁ মারতেই পারেন শতাব্দী প্রাচীন এই রেস্তরাঁয়।
সালদানহা
নিউ মার্কেট থেকে রফি আহমদ কিদওয়াই রোড দিয়ে হেঁটে বাঁদিকে বেঁকে নবাব আবদুর রহমান স্ট্রিট দিয়ে খানিক দূর গেলেই চোখে পড়বে হলুদ রংয়ের একটা বাড়ি। মার্বেলের প্লেটে ‘আই. সালদানহা’ লেখা সেই বাড়ির দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলেই নজরে পড়বে সালদানহাদের ছোট্ট অফিসঘর। পাশের ঘরেই জোরকদমে তৈরি হচ্ছে কেক আর একটা ঘরে থাকে-থাকে সাজানো নানারকম কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি। নাহুম’স-এর পরেই সাবেক কলকাতার বেকারি শপের নাম করতে হয়, তা হলেই আসবে সালদানহার নাম।
আজমিরি বেকারি
মধ্য কলকাতার গলিতে ছোট্ট এক দোকান হিডেন জুয়েল ‘আজমিরি বেকারি’। সেখানে রয়েছে অন্য এক গল্প। এঁরা ধর্মে মুসলমান, বর্তমান মালিক শেখ নাইমুল হক ও তাঁর ভাইয়েরা মিলে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন, চারদিকে নাম করা এত বেকারি শপের মধ্যেও বেশ চলে তাঁদের ছোট্ট দোকান। ব্রিটিশ আমল থেকেই দাদু শেখ আবদুল লতিফের হাত ধরেই ‘আজমিরি বেকারি’র সূত্রপাত। খাজাবাবার নামেই নাম রেখেছেন দোকানের। আগে কলকাতার চার জায়গায় এঁদের দোকান থাকলেও এখন এক জায়গাতেই ‘আজমিরি বেকারি’র দোকান। তবে হাল আমলের ফ্যাশনেবল কেক নয়, এঁরা কিন্তু এখনও বিশ্বাস করেন ট্র্যাডিশনাল ফ্রুট কেকে আর সেটাই ক্রিসমাসে রমরমিয়ে বিক্রি হয়।
দ্য রুজ (The Rouge)
এদের কেক যতটা সুস্বাদু, ততটাই নজরকাড়া ডেকর। তাই তো একবার এখানে পৌঁছে গেলে বারে-বারে ফিরে যেতে মন চাইবে। আর আপনি যদি কেকপ্রেমী হন, তা হলে তো কথাই নেই! রুজের কাপ কেক খেতে যতটা খাসা, ততটাই মুখরোচক এদের চকোলাভা, লিল মিস ক্রেজির মতো কেকও। সবচেয়ে মজার বিষয় হল এদের প্রতিটা কেকের স্বাদই আলাদা রকমের। তাই প্রতিবারই যে নিত্য নতুন স্বাদের সন্ধান পাবেন, তা হলফ করে বলা যায়।
কেকস (Cakes)
গত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ব্র্যান্ডটি। এখন তো কলকাতা শহরের বেশ কয়েকটি জায়গায় এদের শাখা খুলে গেছে, তার কোনওটায় পৌঁছে গেলেই কেল্লা ফতে!
মিয়ো আমোরে (Mio Amore)
কেক প্রেমীদের কাছে এটা খুবই চেনা নাম। এদের কেক-পেস্ট্রি যেমন মুখরোচক, তেমনই নানা স্বাদের স্ন্যাক্সও বেজায় সুস্বাদু।
ক্যাথলিন কনফেকশনারস (Kathleen Confectioners)
এদের থিম নির্ভর বাথ ডে কেক যেমন নজরকাড়া। তেমনই কেক-পেস্ট্রিও বেশ সুস্বাদু। বিশেষত, রাম বলের জনপ্রিয়তা তো আকাশ ছোঁওয়া। এখানেই শেষ নয়, এদের কেকের যেমন সুস্বাদু, তেমনই স্ন্য়াক্সও বেশ মুখরোচক।
সুগার অ্যান্ড স্পাইস (Sugar & Spice)
কলকাতার কেক শপ নিয়ে কোনও আলোচনাই ততক্ষণ শেষ হয় না, যতক্ষণ না সুগার অ্যান্ড স্পাইসের উল্লেখ হয়। এদের কেক এবং পেস্ট্রি যতটা মুখরোচক, ততটাই সুস্বাদু এদের স্ন্যাক্সও। বিশেষত, এদের থিম কেকগুলি বেজায় নজরকাড়া।
কুকি জার (Kookie Jar)
এখানে নানা স্বাদের কেক তো মিলবেই। সঙ্গে উপরি পাওনা মুখরোচক সব স্ন্যাক্স। বিশেষত, চিকেন অনভেলপ এবং প্যাটিস বেজায় সুস্বাদু। পেস্ট্রি খেতে মন চাইলে সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এদের ক্যাপুচিনো পেস্ট্রি এবং চকোলেট স্লাইস বেশ জনপ্রিয়। অনুষ্ঠান অনুযায়ী কাস্টমাইজড কেক তৈরিতেও এরা একনম্বর! নিজস্ব ক্যাটালগ তো বটেই, এমনকী, আপনার দেওয়া ছবি বা মডেল অনুযায়ীও কেক তৈরি করে দিতে পারেন এরা!
দ্য ফ্রেঞ্চ লোফ (The French Loaf)
পকেট বাঁচিয়ে নানা স্বাদের কেক-পেস্ট্রির স্বাদ যদি নিতে হয়, তা হলে এখানে একবার ঢুঁ মারতেই হবে। তবে দ্য ফ্রেঞ্চ লোফ যে শুধু কেকের জন্যই বিখ্যাত, তা নয়। এখানকার স্যালাড এবং স্যান্ডউইচও বেশ মুখরোচক। মিলবে নানা স্বাদের পাঁউরুটি এবং প্যাটিসও। সব মিলিয়ে চটজলদি খিদে মেটাতে এখানে পৌঁছে যেতেই পারেন।
মিসেস ম্যাগপাই (Mrs. Magpie)
আপনি যদি কেকপ্রেমী হন তাহলে মিসেস ম্যাগপাইয়ের কেক একবার হলেও আপনার চেখে দেখা উচিত। এখানকার কাপ কেক ভীষণভাবে জনপ্রিয়। এ ছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের কেক-পেস্ট্রির বিপুল সম্ভার রয়েছে মিসেস ম্যাগপাইয়ের শো-রুমে। পাশাপাশি এদের অন্দরসজ্জাও একটা অন্য মাত্রা যোগ করে।