লোকসংস্কৃতির ভাণ্ডার এই পশ্চিমবঙ্গ। নৃত্য, সঙ্গীত বা হস্তশিল্প, সবক্ষেত্রেই লোকসংস্কৃতির অপার খনি এই বাংলা। সেই লোকসংস্কৃতিরই একটি ধারা রাঢ়বঙ্গের ভাদুগান। মূলত ভাদু উৎসবকে (Bhadu Festival) কেন্দ্র করেই এই গানের প্রচলন। এ হল পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল এবং ঝাড়খন্ডের রাঁচি ও হাজারিবাগের এক লোকউৎসব। তবে এই উৎসবের নেপথ্যে রয়েছে করুণ কাহিনী। ভাদু উৎসব তথা এই গানের প্রচলনকে ঘিরে বেশকিছু গল্প শোনা যায় লোকমুখে।
নীলমণি সিংদেওর মেয়ে ভদ্রাবতী
তারমধ্যে সবচেয়ে প্রচলিত যে গল্প সেটি হল, পঞ্চকোট রাজপরিবারের রাজা নীলমণি সিংদেওয়র তৃতীয় কন্যা ছিলেন ভদ্রাবতী (কেউ কেউ বলেন ভদ্রেশ্বরী)। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেও হবু স্বামীর অকাল মৃত্যুতে চরম মানসিক আঘাত পান তিনি। তারপরেই শোকে আত্মহত্যা করেন ভদ্রাবতী। আসলে বিয়ে করতে আসার পথে হবু বর ও বরযাত্রীরা ডাকাতদলের হাতে নিহত হন। সেই শোকেই স্বামীর চিতায় নিজেকে শেষ করে দেন তিনি। মেয়ের স্মৃতিকে মানুষের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতেই নীলমণি সিংদেও ভাদুগানের (Bhadu Song) প্রচলন করেন।
হেতমপুরের রাজকন্যা ভদ্রাবতী
এইরকমই আরও একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে বীরভূম (Birbhum) জেলায়। সেখানে ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার মেয়ে হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছ। শোনা যায় ভদ্রাবতীর সঙ্গে বিয়ের ঠিক হয়েছিল বর্ধমানের রাজপুত্রের। কিন্তু তারপর ইলামবাজারের কাছে চৌপারির শালবনে ডাকাতদের আক্রমণে নিহত হন বর্ধমানের রাজপুত্র। শোকে বিহ্বল ভদ্রাবতী রাজপুত্রের সঙ্গে সহমরণে যান।
মোড়লের ঘরে বড় হল ভাদু
আরও একটি গল্প রয়েছে, যেখানে ভাদুকে রাজার মেয়ে হিসেবে তুলে ধরা হয়নি। সেই কাহিনী অনুসারে, লারা গ্রামের মোড়ল কোনও এক ভাদ্রমাসে ধানখেতের আলের পাশে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানকে। সদ্যোজাত সেই শিশুকন্যাটিকে বাড়িতে নিয়ে যান মোড়ল। এরপর মোড়ল ও তাঁর স্ত্রী মিলে মেয়েটির নাম রাখেন ভদ্রাবতী, ডাকনাম ভাদু (Bhadu)। মেয়ে যত বড় হয় ততই ফেটে পড়তে থাকে তার রূপ। একদিন সেই মেয়ের কথা জানতে পারেন রাজা নীলমণি সিংদেও। তিনি মেয়েটিকে দত্তক নিতে চান। কিন্তু ভাদু কিছুতেই মোড়ল দম্পতিকে ছেড়ে যেতে চায়নি। তখন রাজা গোটা গ্রামে ঘোষণা করে দেন যে, রাজপ্রাসাদে না থাকলেও ভদ্রাবতী রাজকন্যাই। এরপর ভাদু যখন ষোড়শী সেইসময় গ্রামেরই কবিরাজের ছেলে অঞ্জনের সঙ্গে হয় মন দেওয়ানেওয়া। রাজা জানতে পেরে অঞ্জনকে বন্দি করেন। সেই খবর পেয়ে অঞ্জনের মুক্তির জন্য রাজার কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করে ভদ্রাবতী। কিন্তু রাজার মন গলে না। তখন মনের দুঃখে কয়েদখানার পাশে গান গেয়ে বেড়াতে শুরু করে ভাদু। একদিন সেই গান শুনেই মন গলে রাজার, মুক্তি দেন অঞ্জনকে। কিন্তু কী অবাককাণ্ড ভাদুর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। অনেকে মনে করেন হয়ত শোকে নদীতে আত্মঘাতী হয়েছিল ভাদু। তবে ভাদু না থাকলেও তার গান (Bhadu Gaan) ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।
ভাদুগানের বিষয়বস্তু
বলতে গেলে গোটা ভাদ্র মাস (Bhadra Month) ধরেই চলে ভাদু উৎসব। সঙ্গে গাওয়া হয় ভাদুগান। সাধারণত গ্রামের মহিলা, বিশেষত গৃহবধূদের জীবনের কাহিনীই এই গানের বিষয়বস্তু। তাছাড়া পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদুগানগুলি পাঁচালির সুরে গাওয়া হয়ে থাকে। সেই গানগুলিতে ফুটে ওঠে রামায়ণ, মহাভারত ও রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের পৌরাণিক কাহিনী বা বারোমাস্যা। শোনা যায় আগে ভাদুর কোনও মূর্তি ছিল না। তবে পরবর্তীকালে মূর্তির প্রচলন হয়। এরমধ্যে বীরভূমে ভাদুর মূর্তি বিশেষভাবে দেখা যায়। অঞ্চলভেদে মূর্তি নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানও পালিত হয়। গোটা মাস শেষে ভাদ্র সংক্রান্তির দিন বিসর্জন দেওয়া হয় ভাদুর মূর্তি।
আরও পড়ুন - নার্সিংহোমে ভর্তিই হননি, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থেকে কাটা গেল টাকা