তপন সিনহা (Tapan Sinha) পরিচালিত গল্প হলেও সত্যি ছবিতে একটি দৃশ্যের কথা সকলেরই মনে থাকার কথা। বাড়ির চাকর ধনঞ্জয় (Rabi Ghosh) দুপুরে খাওয়ার পর বাড়ির মহিলাদের উল্টোরথ পত্রিকা থেকে একটি সাক্ষাৎকারের অংশ পড়ে শোনাচ্ছেন। সাক্ষাৎকারটি ছিল মহানায়ক উত্তম কুমারের। সেটি শোনার পর বাড়ির সেজ বউয়ের চরিত্রে অভিনয় করা ভারতী দেবীর দীর্ঘশ্বাসটি মনে করা চেষ্টা করুন একবার। একটি অভিব্যক্তি বলে দেয় সে সময় নারী মনে, সর্বোপরি দর্শক মনে কী রকম প্রভাব ফেলেছিলেন উত্তম কুমার (Uttam Kumar)।
উত্তমের আগেও বাংলা সিনেমার স্ক্রিন দাপিয়ে বহু অভিনেতা অভিনয় করেছেন। তাঁদেরও ফ্যান ফলোইং কম ছিল না। সমকালীন নায়কদের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় বা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের মতো হাতে আঁকা সৌন্দর্য নিয়ে স্ক্রিনে আসেননি উত্তম। তা হলে কী ভাবে কয়েক প্রজন্মকে নিজের উপস্থিতি এবং অভিনয়ের জাদুতে মাতিয়ে রেখেছিলেন উত্তম? মৃত্যুর ৪১ বছর পরেও সেই অমোঘ আকর্ষণে ভাটা পড়েনি। বেশিরভাগ ফিল্মবোদ্ধাদের মতে, উত্তমের অভিনয় আর রোম্যান্টিসিজম তাঁর সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা নিয়েছিল, এ কথা ঠিক। কিন্তু তাঁর সর্বজনীন আবেদন তৈরি করেছিল পাশের বাড়ির ছেলে ইমেজ।
দেয়া নেয়া ছবিতে যখন উত্তমের বাড়ি থেকে চলে যাওয়া আটকাতে ছায়াদেবী প্রাণপন চেষ্টা করছেন, সে সময় বাংলার যে কোনও মা হয়তো আঁচলের কোনায় চোখ মুছেছেন। একই ভাবে যখন হারানো সুর ছবিতে সুচিত্রা সেনের (Suchitra Sen) দিকে তাকিয়ে প্রেম নিবেদন করছেন তখন তরুণী থেকে মধ্য বয়সি মহিলাদের মনে কাঁপন ধরে গিয়েছিল। এমন সর্বজনীনতা উত্তম কুমারের আগে কোনও নায়ক অর্জন করতে পারেননি। উত্তম চলে যাওয়ার পর অনেক নায়কের নাম তর্ক সাপেক্ষে আসতে পারে, কিন্তু তা কেবল তর্কের খাতিরেই।
একটা আক্ষেপের বিষয় না বললেই নয়। এই বাংলায় বেঁচে থাকতে বহু শিল্পী মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর প্রশংসা পেয়েছেন। সমালোচনাও কম কুড়োননি। কিন্তু খুব কম শিল্পী তাঁদের যোগ্য সম্মান পেয়েছেন। তালিকাটি বেশ লম্বা। তুলসি চক্রবর্তী, জহর রায়, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, কানন দেবী, ছবি বিশ্বাস, রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, উৎপল দত্ত - এমন বহু নাম রয়েছে, যাঁরা তাঁদের প্রতিভার প্রকৃত সম্মান পাননি। এই তালিকায় রয়েছেন উত্তম-ও। বহুবার একাধিক জায়গায় তাঁর বহু সহকর্মী এই আক্ষেপ করেছেন। আজও করেন। মৃত্যুর পর তাঁকে নিয়ে যে এত আলোচনা, এত পজিটিভ সমালোচনা, তিনি বেঁচে থাকতে এ সব হলে হয়তো একটু শান্তি পেতেন উত্তম।
তাঁর সাংসারিক জীবন তেমন একটা সুখের হয়নি। দুই নারীর মাঝে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দুই সংসারের চোরাস্রোতে চিরকাল ব্যালান্স করতে গিয়েই নিজে হয়তো ব্যালান্স হারিয়েছিলেন। এ সব থাকা সত্ত্বেও তাঁর জায়গা কেউ নিতে পারেননি। তার জন্য দায়ী সেই পাশের বাড়ির ছেলের ইমেজই। তিনি যে খুব রক্ত মাংসের মানুষ, খুব কাছের। নায়ক হয়েও সাধারণ! সাধারণ হয়েও অসাধারণ! সত্যিই অসাধারণ!