বাংলার পুথি আজকের দিনের ছাপার অক্ষরে বই হয়ে উঠেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে। সে সময় ভারতে খ্রিস্টধর্মের প্রচারে এসে বাঙালিদের শিক্ষার প্রসারে মনোনিবেশ করেন এক ইংরেজ। বাঙালিদের লেখা-পড়ায় শিক্ষিত করে তুলতে গিয়ে নিজেও আপাদমস্তক বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন ভারতে আসা খ্রিস্ট ধর্মের ধর্মপ্রচারক উইলিয়াম কেরি (William Carey)।
তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ব্যাপতিস্ত মিশনারি সোসাইটির প্রতিনিধি। মূলত খ্রিস্ট ধর্মের প্রসারেই ১৭৯৩ সালে বাংলায় আসেন উইলিয়াম কেরি। কিন্তু দুর্বোধ্য ভাষায় ধর্মকথা মানুষের মনে দাগ কাটতে পারবে না, সেটা বুঝেছিলেন তিনি। তাই বাঙালিকে তাঁর মাতৃভাষাতেই খ্রিস্টধর্মের মহিমা বোঝানোর কাজে লেগে পড়েন তিনি।
বাঙালিকে তাঁর মাতৃভাষাতে খ্রিস্ট ধর্মের পাঠ পড়াতে প্রথমে কেরিকে পুরোদমে বাংলা শিখতে হয়। সেই সময়ে উইলিয়াম কেরির বাংলা চর্চা প্রসঙ্গে সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন (২ নভেম্বর ২০১১ আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়), “বাঙালিরা তখন বাংলা ভাষায় কথা বলে বটে, কিন্তু কিছু চিঠিপত্রের কথা বাদ দিলে, গদ্য ভাষা লিখতে জানে না। ছাপাখানা এসে গেছে, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ছাপার মতো বিশেষ কিছু নেই, পুরনো কালের কবিতা ছাড়া।”
বাঙালিকে তাঁর মাতৃভাষাতেই খ্রিস্টধর্মের পাঠ পড়াতে বাংলা ভাষায় বাইবেল অনুবাদ করার কাজ শুরু করেন উইলিয়াম কেরি (William Carey)। সোজা চলে যান উত্তরবঙ্গের মালদায়। সেখানে মুদ্রণযন্ত্র, কাগজ, কালি ও হরফ সংগ্রহ করে বাংলা হরফে বাইবেলের অনুবাদ ছাপার কাজ শুরু করেন তিনি। ১৭৯৯ সালে কেরির সঙ্গে বাইবেলের অনুবাদ ছাপার কাজে যোগ দেন মুদ্রণ বিশারদ উইলিয়ম ওয়ার্ড। কিন্তু ঘটনাচক্রে উত্তরবঙ্গের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাদের বিরাগভাজন হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হতে হয় উইলিয়াম কেরিকে।
উত্তরবঙ্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে কেরি আশ্রয় নেন তৎকালীন ডেনমার্ক সরকারের উপনিবেশ শ্রীরামপুরে। ১৮০০ সালের ১৩ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠা হয় শ্রীরামপুর মিশন। সে বছর মার্চে উইলিয়ম ওয়ার্ডের নেতৃত্বে চালু হয় ছাপাখানা। ১৮০০ সালের ১৮ মার্চ শ্রীরামপুর মিশনের ছাপার মেশিনে ছাপা হয় দুই খণ্ডের বাংলা বাইবেল। এর পরবর্তী ৩২ বছরে শ্রীরামপুরের ওই ছাপাখানা থেকে মোট ৪৫টি ভাষায় ২ লক্ষ ১২ হাজার বই প্রকাশিত হয়েছিল। সেই সময়ের হিসাবে যা এক কথায় দৃষ্টান্তমূলক, নজিরবিহীন!
১৮১৮ সালে উইলিয়াম কেরি (William Carey) উইলিয়ম ওয়ার্ডের উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত শ্রীরামপুর কলেজ। সাহিত্যচর্চা ও সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালির বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। এই বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে উইলিয়াম কেরির অবদানও কিছু কম নয়। কারণ, বাঙালিকে গদ্য ভাষায় লিখতে শিখিয়েছিলেন তিনি। শোনা যায়, বিদ্যাসাগরও বাঙালিদের শিক্ষার প্রসারে কেরির সাহায্য পেয়েছিলেন।