বাংলাদেশের তিস্তা নদীর জলবণ্টন নিয়ে কথা বলতে ভারতের একটি দল শিগগিরই ঢাকা যেতে পারে। তিস্তা নদী নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। যতবারই আলোচনা হয়েছে, শেষ মুহূর্তে বাধা এসেছে। ফরাক্কার গঙ্গার জলবণ্টন নিয়েও এবার ক্ষুব্ধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, যেহেতু তিস্তা ও ফরাক্কা বাংলা অবস্থিত, তাই পশ্চিমবঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত না করে বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের কোনও চুক্তি করা যাবে না।
তিস্তা কোথায়, এই নদী কত বড়?
তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। আনুমানিক ৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি হিমালয়ের পাহুনারি পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যা সিকিম সংলগ্ন। এখান থেকে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশে যায়, ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়। নদীপথের ৩০০ কিলোমিটারের বেশি পড়ে ভারতে, যেখানে ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি রয়েছে বাংলাদেশে।
কোন প্রকল্প নিয়ে বারবার আলোচনা হয়?
গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে বৈঠকে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিস্তা নদীও তার মধ্যে অন্যতম। তিস্তা নদী সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ভারত থেকে একটি প্রযুক্তিবিদদের দল বাংলাদেশে যাবে, যেখানে সমীক্ষার বিষয়ে অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এর মধ্যে রয়েছে নদীর জল ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করা। এই স্কিম বেশ ব্যয়বহুল হতে পারে।
চিনও এই প্রকল্পের ওপর জোর দিচ্ছে
অন্যদিকে চিনও এতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। এমনকী হাসিনা প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করতে আগামী মাসে সেখানে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে, চিন বাংলাদেশকে একটি আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিয়েছে। চিনের প্রস্তাব হল, তারা এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ১৫ শতাংশ বহন করবে, বাকি ব্যয় যা হবে হবে, তা ঋণ হিসেবে দেবে বাংলাদেশকে। এখন ভারত বা চিন, কার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন হাসিনা এবং কোনটি এড়িয়ে যাবেন, সে বিষয়ে সরাসরি কিছু বলতে চাইছেন না বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এই পরিকল্পনা ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ কারণ বাংলাদেশ যদি বেজিংকে রাজি করে তাহলে সে দেশ সংলগ্ন ভারতীয় সীমান্তে চিনের উপস্থিতি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষুব্ধ কেন?
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, তিনি রাজ্যের স্বার্থের জন্যই বাধা দিচ্ছেন। জল বণ্টনের কারণে বাংলায় ভাঙন, বন্যা ও পলি জমার সমস্যা বাড়বে। ২০১১ সালেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় এই চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। মমতাকেও দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি যেতে রাজি হননি। চুক্তিও স্থগিত করা হয়েছিল সে বার। বস্তুত গঙ্গার পরে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। এর ওপর বাঁধ নির্মাণ করলে জল প্রবাহ সীমিত হবে বলে অভিযোগ।
পরবর্তীতে কী হতে পারে?
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতায় বারবার আটকে যায় প্রকল্পটি। এবারও সেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সম্মত না হলে কোনও মেগা প্রকল্পে কাজ করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে আবারও ২০১১ সালের মতো পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে কি বিরোধ দেখা দিয়েছে?
তিস্তা নদীর অর্ধেকের বেশি ভারতীয় সীমান্তের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, আর এক-চতুর্থাংশ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। প্রতিবেশী দেশ বলছে, নদীর জলের ৫০ শতাংশ পাওয়া উচিত, বিশেষ করে শুষ্ক মরসুমে, যাতে তার জলের চাহিদা মেটানো যায়। ভারতের প্রস্তাবে ৩৭.৫ শতাংশ বাংলাদেশকে দেওয়া হবে, যেখানে ভারত ৪২.৫ শতাংশ ধরে রাখবে, বাকিটা স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হবে। পশ্চিমবঙ্গে তিস্তার উপর সেচ ও মাছ চাষের মতো খাল রয়েছে এবং আরও এই ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। খাল নির্মাণের ফলে নদীর জল আরও কমবে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
প্রকল্পটি ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কেন?
আন্তঃসীমান্ত নদী সমস্যা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অভিন্ন। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে ভারত ও নেপাল পর্যন্ত নদী নিয়ে বিরোধ ছিল। তবে তিস্তা নদী আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চিনও এতে আগ্রহ নিচ্ছে বলে। প্রকল্পের স্থানটি চিকেনস নেকের কাছাকাছি। এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ২৮ কিলোমিটারের একটি প্রসারিত, যা উত্তর-পূর্বকে দেশের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এতে বাংলাদেশ ও নেপালও রয়েছে। এমতাবস্থায় চিন কোনও ভাবে ঢাকাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলে নিরাপত্তার দিক থেকে তা বিপজ্জনক হতে পারে।