বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কথা না বলার সমস্যাটা তৈরি হয় শুনতে না পাওয়ার সমস্যা থেকেই। কোনও শিশু জন্ম থেকে কথা বলছে না, বাবা-মা বা বাড়ির লোক ভেবে নিলেন, এখনও বোধহয় মুখে কথা ফোটেনি। বছর দুই-তিনেক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন কথা বলছে না তখন সন্দেহ দানা বাঁধল, সমস্যা অন্য কোথাও নয় তো! এই সচেতনতা বা সময় মতো চিকিৎসার অভাবে বোকা-কালা শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বিশ্ব জুড়ে। যার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসল সমস্যা শ্রবণের।
ভারতেও মুক-বধির শিশুর সংখ্যা নেহাত কম নয়। পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিমবঙ্গেও প্রত্যেক ১০০ জন শিশুর মধ্যে চার জনের শ্রবণশক্তি ক্ষীণ বা শ্রবণেন্দ্রীয়ের সমস্যা রয়েছে, জানালেন এসএসকেএম হাসপাতালের (SSKM Hospital) ইন্সটিউট অফ ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড এন্ড নেক সার্জারি বিভাগের প্রধাণ চিকিৎসক ডঃ অরুনাভ সেনগুপ্ত (Dr Arunabha Sengupta)। ডঃ সেনগুপ্ত জানান, এই চিকিৎসা বেশ খরচ সাপেক্ষ।
ডঃ সেনগুপ্ত জানান, শ্রবণশক্তির সমস্যা জন্মগত হতে পারে। আবার টাইফয়েড, মেনিনজাইটিস বা এনসেফেলাইটিসের মতো অসুখের কারণেও শিশু তার শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। তাই প্রথমে বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর বধির হওয়ার কারণটি অুসন্ধান করতে হয়। কারণ জানার পর পদ্ধতি মেনে এগোয় চিকিৎসা। এ ক্ষেত্রে ককলিয়া ইমপ্লান্টের (Cochlear Implant) মতো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সফল ভাবে শ্রবণ ক্ষমতাকে স্বাভাবিক করা যেতে পারে।
কী এই ককলিয়া ইমপ্লান্ট (Cochlear Implant)?
ককলিয়া ইমপ্লান্ট (Cochlear Implant) আসলে একটি ছোট্ট যন্ত্র বিশেষ, যার সাহায্যে ককলিয়ার স্নায়ু-কে উদ্দীপ্ত করে শব্দের অনুভূতি মস্তষ্কে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই যন্ত্রটির একটি অংশ থাকে কানের ভিতরে অন্যটি থাকে বাইরের দিকে।
ককলিয়া ইমপ্লান্ট (Cochlear Implant) অস্ত্রোপচার কী ভাবে হয়?
ডঃ সেনগুপ্ত জানান, জেনারেল অ্যানাস্থেশিয়ার মাধ্যমেই ককলিয়া ইমপ্লান্ট অস্ত্রোপচারটি করা হয়। এর মাস্টেড অস্থিকে খোলার জন্য প্রথমে কানের পিছনে একটি ছিদ্র করা হয়। তারপর ককলিয়া স্নায়ুর নাগাল পাওয়ার জন্য মুখ ও মাস্টেড হাড়ের মাঝখানে ফাঁকা জায়গা তৈরি করা হয়। ককলিয়া খুলে গেলে ওই যন্ত্রটিকে এখানে বসিয়ে দেওয়া হয়, আর কানের পিছনের ত্বকের দিকে থাকে এই যন্ত্রের রিসিভার। এই যন্ত্রটি বসিয়ে কানের পিছনের ওই ছিদ্রটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ডঃ সেনগুপ্ত জানান, শুধু অস্ত্রোপচারেই শ্রবণশক্তি ফেরে না। তারপর শুরু হয় স্পিচ থেরাপি এবং আনুসাঙ্গিক নানা প্রশিক্ষণ। শিশুকে বা রোগীকে শব্দের সঙ্গে পরিচিত করানোর লড়াই চলে। এই লড়াইয়ে সামিল হতে হয় রোগীর পরিবার কে বা শিশুর বাবা-মা-কেও। এই প্রশিক্ষণের জন্য এসএসকেএম হাসপাতালে (SSKM Hospital) একটি বিশেষজ্ঞ দলও রয়েছে। তাঁদের সামগ্রিক পর্যবেক্ষণেই চলতে থাকে গোটা পক্রিয়াটি।
এই বিষয়ে ইন্সটিউট অফ ওটোরাইনোল্যারিঙ্গোলজি হেড এন্ড নেক সার্জারি বিভাগের আর এক চিকিৎসক ডঃ অনিন্দিতা সেনগুপ্ত (Dr Anindita Sengupta) জানান, ২০১৬ থেকেই এসএসকেএম-এ (SSKM Hospital) এই ধরণের অস্ত্রোপচার হচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ADIP প্রকল্পের মাধ্যমে দুঃস্থ পরিবারের শিশুদের বিনামূল্যে এই যন্ত্রটি দেওয়া হয়। বাইরে এই যন্ত্রটির দাম ৬ থেকে সাড়ে ৬ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার সামগ্রিক খরচ প্রায় সাড়ে ১৪ লক্ষ টাকা। দরিদ্র মানুষের পক্ষে তো সম্ভব নয়ই, মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রেও চিকিৎসার এই বিপুল খরচ বহন করা প্রায় অসম্ভব। রাজ্য সরকারের অর্থ সহায়তায় নিখরচায় এই চিকিৎসা পাচ্ছেন রাজ্যের বহু মানুষ। পাঁচ বছর বা তার কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচার বা তার পরবর্তী থেরাপিগুলির ক্ষেত্রে সাফল্য দ্রুত মেলে।
কী ভাবে আবেদন করা হয় এই ককলিয়া ইমপ্লান্টের (Cochlear Implant) জন্য?
ডঃ অনিন্দিতা সেনগুপ্ত জানান, শিশুর সমস্ত রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফেই শিশুর নাম করে একটি আবেদন পাঠানো হয় কেন্দ্রের কাছে। কেন্দ্র থেকে ওই যন্ত্রটি চলে এলেই বাকি চিকিৎসার দায়ভার বহন করে রাজ্য সরকার। তবে খুব শীঘ্রই গোটা প্রকল্পটি রাজ্য সরকারের আওতায় আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই চার শিশুর জন্য এই মেশিনের খরচও বহন করেছে রাজ্য সরকার। বিগত পাঁচ বছরে এই ধরণের অস্ত্রোপচারে ৬৭ জনের শ্রবণক্ষমতা ফিরেছে। আরও ৫০ শিশুর অস্ত্রোপচার এখন সময়ের অপেক্ষা।