একুশের নির্বাচনে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গে ভালো ফল করেছে বিজেপি। এরইমধ্যে পশ্চিমবঙ্গকে ভেঙে তিনভাগ করার দাবি তুলেছে গেরুয়া শিবিরের একাংশ। উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি তুলেছেন আলিপুরদুয়ারের সাংসদ জন বার্লা। আবার আজ জঙ্গলমহল ও রাঢ়বঙ্গ নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গড়ার দাবি তুলেছেন গেরুয়া শিবিরের আর এক সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। বিজেপির একাংশের এই 'বঙ্গভঙ্গ'-র দাবিকে নিয়ে রীতিমতো সরগরম রাজ্য রাজনীতি।
কয়েকদিন আগেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছিলেন, বাংলাকে ভাগের চক্রান্ত করছে বিজেপি। যা তিনি হতে দেবেন না। আবার বিজেপির-এর 'চক্রান্ত' ভেঙে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে, তৃণমূল নেত্রী তথা তাঁর দলের বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ও গেরুয়া শিবিরের দুই সাংসদের কারণে রাজ্যে এখন হটটপিক হয়ে উঠেছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। কিন্তু, মৌলিক প্রশ্নটি হল উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলকে কি আদৌ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা সম্ভব? আসুন দেখি।
এই নিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তথা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহানন্দা কাঞ্জিলাল বলেন, '১৯৫৬ সালে সপ্তম সংশোধনীতে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংবিধানের ২৩৯ আর্টিকেলে বলা আছে, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পরিচালিত হবে কেন্দ্র সরকার দ্বারা। আর এর প্রশাসনিক প্রধান রাষ্ট্রপতি। আগে মূলত উত্তর-পূর্বের একাধিক জায়গা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছিল। পরে সেগুলিকে রাজ্যতে পরিণত করা হয়। আমাদের দেশে এখনও দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, পুদুচেরি-সহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। কিন্তু, এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির জন্যই ভারতকে সেমি ফেডেরাল ইউনিউন বলা হয়। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলো না থাকলে ভারতকে ফেডেরাল ইউনিউন বলা হতো।'
মহানন্দা কাঞ্জিলালের কথায়, একটি রাজ্যকে ভেঙে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার সংস্থান সংবিধানে রয়েছে। কিন্তু, সেটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা দেখেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ার সম্ভাবনা কতখানি? এই বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এক্রামূল বারি বলেন, 'প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক এই বিষয়গুলির উপর নজর রেখে রাজ্যকে ভাগ করার দাবি জানানো যেতে পারে। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা আলাদা রাজ্য যখনই গড়ে উঠেছে তখন উপরের চারটি দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, বিজেপির দু একজন সাংসদ যে দাবি করছেন তার কোনও বাস্তাব ভিত্তি নেই। আইনি পথেই তাঁরা আটকে যাবেন। কারণ, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক- এই সংকটগুলির কোনওটিই পশ্চিমবঙ্গে নেই।'
আর এক বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, 'কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার যে দাবি বিজেপির একাংশ করছে তা ভিত্তিহীন। আইনত পারবে না। কারণ, এই নিয়ে বিধানসভার সম্মতি লাগবে। সেখানেই আটকে যাবে গেরুয়া শিবিরের লোকজন। আবার যাঁরা পৃথক রাজ্য চাইছেন বা চাইছেন না, সেই দুই পক্ষের মতামত কেন্দ্র শুনতে পারে। কিন্তু, সে পথও খোলা নেই বিজেপির কাছে। দলের রাজ্য সভাপতি ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন তিনি বাংলা ভাগের পক্ষে নন। তাহলে একজন বা দুজন সাংসদের দাবি ধোপে টিকবে না।'
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হলেও কি সুবিধা পাবে উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহল?
প্রসঙ্গত, বিজেপি সাংসদ জন বার্লার অভিযোগ, উত্তরবঙ্গকে বারবার বঞ্চনা করা হয়েছে। বর্তমান রাজ্য সরকার উত্তরবঙ্গের জন্য কিছুই করেনি। জঙ্গলমহল ইস্যুতেও একই অভিযোগ করেন সৌমিত্র খাঁ। তাহলে কি বিজেপি সাংসদদের একাংশ মনে করছেন, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হলেই উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলের উন্নতি হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মহানন্দা কাঞ্জিলালের মত, উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করলে সেই জায়গাগুলি আলাদা সুবিধা পাবে বা অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি করবে এমন কোনও সম্ভাবনা নেই। বরং পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশি। অতীত তাই বলছে। তাঁর কথায়, 'আন্দামান-নিকোবর একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। যার GDP সবথেকে কম। আগে যে সব উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ছিল (এখন রাজ্য) সেগুলির GDP আজও কম। একই কথা প্রযোজ্য জম্মু-কাশ্মীর, পুদুচেরির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রেও। সেখানে মহারাষ্ট্র বা অন্য রাজ্যগুলির GDP কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির তুলনায় অনেক বেশি।
তিনি আরও বলেন, 'দারিদ্রের দিক থেকে দেখলেও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির পরিসংখ্যান সন্তোষজনক নয়। গোটা দেশে দারিদ্রের হার ২১.৪২ শতাংশ। কিন্তু, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল চণ্ডীগড়ের দারিদ্রের হার ২১.৮১ শতাংশ। দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউ-এর ৩৯.৩১ শতাংশ। অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলি এগিয়ে থাকছে তা একেবারেই নয়।'
এখন প্রশ্ন হল, উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা হলে কি সুবিধা হবে? উত্তরে মহানন্দাদেবী বলেন, 'উত্তরবঙ্গ বরাবরই বঞ্চনার অভিযোগ তুলেছে। এই দাবিকে খতিয়ে দেখা দরকার সরকারের। অনেকদিন কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল। তারপর বামেরা ছিল ৩৪ বছর। এখন তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। সরকারের উচিত উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহলের মানুষের দাবিদাওয়াকে খতিয়ে দেখে পরিকাঠামোগত উন্নয়ন করা। আর একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, কেন্দ্রের অধীনে থাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। তাই তাদের অর্থনৈতিকভাবেও সম্পূর্ণভাবে কেন্দ্রের তাকিয়ে থাকতে হয়। তাই কেন্দ্রের অধীনে থেকে উত্তরবঙ্গ বা জঙ্গলমহল উন্নতি করবে পারবে কিনা, সেটা তর্ক সাপেক্ষ বিষয়।'
তাহলে কেন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের দাবি তুলছে বিজেপি? এই নিয়ে তৃণমূল নেতা কুণার ঘোষের বর্ক্তব্য, 'বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্ত করছে বিজেপি। তাই তারা এসব এখন বলছে। সবটাই ওদের রাজনীতি। বাংলার মানুষ এর জবাব দেবে।' কার্যত একই সুর শোনা যায় উত্তরবঙ্গের সিপিআইএম নেতা অশোক ভট্টাচার্যের গলায়। তিনি বলেন, 'যারা এই দাবি করছেন তাঁদের কোনও রাজনৈতিক দর্শন নেই। সেকারণে আজ এই দল কাল সেই দলে যান। নিজেদের লাইমলাইটে রাখতে এসব প্রচার করছেন তাঁরা। এর আগেও উত্তরবঙ্গকে ভাগ করার চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু, তা সফল হয়নি। এবারও হবে না।'