রাঢ়বঙ্গ মানেই খুব সহজাত ভাবে উঠে আসে ঝুমর গানের (Jhumur Song) কথা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে লালমাটি, সঙ্গে একদল মানুষের নির্দিষ্ট ছন্দে তৈরি করা সুরের মায়াজাল। পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, পার্শ্ববর্তী ঝাড়খন্ডের (Jharkhand) রাঁচি, হাজারিবাগ, পালামৌ, ধানবাদ, গিরিডি, ওডিশার (Odisha) ময়ূরভঞ্জ, সম্বলপুর এমনকি অসম (Assam) রাজ্যেও এই গানের চর্চা রয়েছে। লোক গবেষকরা বলেন, প্রাচীনকাল থেকে যত ব্যাপ্তি লাভ করেছে ঝুমুর গান গান ততই বেড়েছে এর প্রকারভেদ। স্থান, কাল, ঋতু, অঞ্চল ভেদে রয়েছে বিভিন্ন ধারার ঝুমুর।
বিখ্যাত ঝুমুর গীতিকার সুনীল মাহাত জানাচ্ছেন, এই গান বহু প্রকারের। তিনি জানাচ্ছেন, শুধুমাত্র ভাদরিয়া ঝুমুরই রয়েছে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ রকমের। ঝুমুর গানের অতি প্রাচীন এই ধারা। মূলত কুরমালি এবং মানভূমের ভাষায় গাওয়া হয় ভাদরিয়া ঝুমুর। একে পাতা নাচের ঝুমুরও বলা হয়ে থাকে। পরবর্তী সময় মধ্যযুগে প্রচলন হয় দরবারি ঝুমুরের। যেখানে আদি ঝুমুরের সঙ্গে মিশে যায় রাগসঙ্গীত। তৈরি হয় বাঘমুন্ডি, কাশীপুর সহ বিভিন্ন ঘরানা। বাঘমুন্ডি ঘরানার প্রখ্যাত দরবারি ঝুমুর শিল্পী ছিলেন রামকৃষ্ণ গঙ্গোপাধ্যায়। একসময় বাঘমুন্ডি ঘরানায় ধামসা, ঢোল, সাঁনাইয়ের মত বাদ্যযন্ত্র সহযোগে পরিবেশন করা হত দরবারি ঝুমুর। পরবর্তী সময়ে কাশীপুর ঘরানায় ঝুমুর গানে সংযোজিত হয় তবলা, মাদল, হারমোনিয়াম, বাঁশির মতো বাদ্যযন্ত্র। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে ভিত্তি করেই রচিত এই ধরনের ঝুমুর। এছাড়া দরবারি ঝুমুরে পাওয়া যায় দেহতত্ত্বও। আবার অুঞ্চল ভেদে এই দরবারি ঝুমুরের পার্থক্য রয়েছে বলে জানাচ্ছেন সুনীলবাবু। সেক্ষেত্রে ছোটনাগপুর, বাঘমুন্ডি, ঝাড়গ্রাম সহ বিভিন্ন এলাকার দরবারি ঝুমুরের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে বলেই জানাচ্ছেন তিনি। এছাড়া মূলত চৈত্র মাসে যে ঝুমুর গাওয়া হয়, অর্থাৎ চৈতালি ঝুমুরের কথাও উল্লেখ করলেন সুনীল মাহাত।
আবার ঝুমুর শিল্পী তথা গবেষক দোলা রায় জানাচ্ছেন, বিভিন্ন ভাবে করা হয়েছে ঝুমুরের প্রকারভেদ। তাঁর মতে, কেউ অঞ্চলগত ভাবে, কেউ অনুষ্ঠানগত ভাবে, কেউ আবার যুগের বিচারে ঝুমুরকে ভাগ করেছেন। এক্ষেত্রে ওডিশার এক গবেষেক গিরীশচন্দ্র মহান্তর কথা উল্লেখ করলেন দোলা রায়। গিরীশবাবু মূলত ঝুমুরকে ৪টি যুগে ভাগ করেছেন। সেই অনুযায়ী ১৭৫০ সালের আগের সময়টা আদিযুগ, ১৭৫০ থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত মধ্যযুগ, ১৮৫০ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত কাব্যযুগ এবং ১৯৫০ এর পরের সময়টা আধুনিক যুগ। আবার যদি অঞ্চল ভেদে দেখা যায়, তাহলে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান সহ বিভিন্ন জায়গার ঝুমুরের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ঠ। অন্যদিকে কেউ কেউ আবার বৈশাখী, বাসন্তিয়া, করমনাচের মতো অনুষ্ঠানের ভিত্তিতেও ঝুমুরকে ভাগ করেছেন বলে জানাচ্ছেন শিল্পী। এছাড়া তালের ভিত্তিতেও ঝুমুরের প্রকারভেদ রয়েছ। সেক্ষেত্রে পাতকুলা, বেগারি, নাগপুরিয়ার মতো বিশেষ বিশেষ তালের প্রেক্ষিতেও ঝুমুরকে ভাগ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।