২০১১ সালে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অহঙ্কারকে চূর্ণবিচূর্ণ করে বাংলার ক্ষমতায় এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতাকে নিয়ে তখন নতুন করে স্বপ্ন দেখেছিল এরাজ্যের মানুষ। দেখতে দেখতে বাংলায় মসনদে ৯ বছর হয়ে গেল তৃণমূলের। এই ৯ বছরে নানান ওঠপড়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। এর মধ্যে যেমন রয়েছে ২০১৬ সালে রেকর্ড গড়ে তৃণমূলের ফের ক্ষমতায় ফিরে আসা তেমনি ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার সামনে পড়া। আর মাত্র ৬ মাস! তারপরেই এরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। করোনাকালে বিহার বিধানসভা ভোট করে নির্বাচন কমিশন বুঝিয়ে দিয়েছে বাংলাতেও যথাসময়ে হবে ভোটরঙ্গ। তার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে কমিশন। এই আবহে ঘর গোছাতে শুরু করেছে সব শিবিরই। মমতা বন্দ্যাপাধ্যায় আবার তাঁর ক্যারিশ্মার জোড়ে হ্যাটট্রিক করে তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরবেন নাকি স্বপ্ন পূরণ হবে মোদী-শাহ জুটির, তার উত্তর সময়ই বলবে। তবে বিনা যুদ্ধে যে কোনও পক্ষই সূচাগ্য মেদিনী ছাড়বে না তা স্পষ্ট।
বিহার ভোটের পর থেকেই বাংলায় রাজনৈতিক সক্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছে গেরুয়া শিবির। শোনা যাচ্ছে প্রতিমাসে ভোট প্রচারে আসবেন স্বয়ং অমিত শাহ। বাদ যাবেন না সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডাও। আসবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। যেভাবেই হোক বাংলা বিজয়ে কোন ঢিলেমি দিতে রাজি নয় গেরুয়া শিবির। তাই প্রতিদিনই তৃণমূলনেত্রীর দিকে তোপ উড়ে আসছে বিজেপির ছোট-বড় সব নেতাদের থেকেই। এরাজ্যে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই বাংলা শাসনের ক্ষমতার হাতবদল হয়েছিল। বাংলার মসনদে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাম আমলের খরা কাটিয়ে এরাজ্যের শিল্পের বন্যা বইবে এমন স্বপ্নই দেখেছিল আমজনতা। কিন্তু বিরোধীদের অভিযোগ গত ৯ বছরে এরাজ্যে বড় করে শিল্প সম্মেলন হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আসেনি পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ। ফলে বেড়েছে বেকারত্ব, পিছিয়ে পড়েছে রাজ্য। আর নিজেদের প্রচারে এই বিষয়টিকেই সুচারু ভাবে ব্যবহার করতে চাইছে গেরুয়া শিবির। তাই বিজেপি রাজ্য সভাপতি প্রকাশ্যেই ক্ষমতায় এলে এ রাজ্যেকে গুজরাত বানানোর চ্যালেঞ্জ করছেন। সেই গুজরাত যেখানে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকরা রোজগারের জন্য যান। যেখানে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে টানা ১৩ বছর ক্ষমতায় ছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মোদীর সেই গুজরাত মডেলকেই এবার নবান্ন দখলের লড়াইয়ে ট্রাম্পকার্ড হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে গেরুয়া শিবির।
তবে কেবল উন্নয়ন বা বেকারত্বের প্রসঙ্গই নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবার মোকাবিলা করতে হবে বিজেপির আরও একাধিক অস্ত্রের। তার মধ্যে অবশ্যই কাছে বহিরাগত ইস্যু। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে চলতি বছরের শুরুতেই উত্তাল হয়েছিল গোটা দেশ। এনআরসি ইস্যুতে ময়দানে নেমেছিলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। আর তা নিয়ে বাংলাদেশি ইস্যুতে তৃণমূলনেত্রীকে পাল্টা নিশানা করেছিল বিজেপি শিবির। মুখ্যমন্ত্রী যে কেবল বিশেষ এক সম্প্রদায়ের মানুষকেই তোষন করে চলেছেন এমন অভিযোগ বারবার তুলেছে বিজেপি শিবির। হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে পাশে পেতে এরাজ্যে বেড়ে চলা জঙ্গি কার্যকলাপ নিয়েও সরব হয়েছে বিজেপি। অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল আমলে বাংলায় ঘাঁটি গেড়েছে আইএসআই-এর মতো জঙ্গি সংগঠন। এমনকি জঙ্গি ঘাঁটি নিয়ে বাংলাকে কাশ্মীরের সঙ্গে তুলনা করেছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যটিতে বিজেপির সাম্প্রদায়িক নীতির কার্যকারিতা নেই বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু গত লোকসভার ফলাফল সব হিসাব নিকাশ উল্টে দিয়েছে।
এরমধ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবচেয়ে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে দলের ভাঙন। তিল তিল করে গড়ে ওঠা তৃণমূলের সাজানো রাজনৈতিক বাগান ভাঙতে শুরু করেছে। আগামী বছরের এপ্রিল-মে মাসে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনের আগেই এই বাগান আরও তছনছ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এদিকে এরাজ্যে বিজেপিও তার সংগঠন গুছিয়ে নিয়েছে পাটিগণিতের নিয়ম মেনেই। লোকসভা ভোটের আগেই চমক লাগিয়ে দিয়ে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি শিবিরে নাম লিখিয়েছিলেন মুকুল রায়। সেইপথ অনুসরণ করে সব্যসাচী দত্ত, শোভন চট্টোপাধ্যায়ের মত তৃণমূল নেতারা গেরুয়া পতাকা কাঁধে নিয়েছেন। মমতার এককালের ডান হাত হিসেবে পরিচিত শুভেন্দু অধিকারীও রাজ্য মন্ত্রিসভা থেকে ইতিমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। তিনিও শিবির বদল করতে পারেন বলে জোড় জল্পনা চলছে। আগামী দিনে ঘাসফুল শিবিরের আরও অনেক নেতাই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপির ঝান্ডা হাতে নেবেন বলেই দাবি করে চলেছে গেরুয়া নেতৃত্ব। একসময় দল ভাঙানোর যে খেলা তৃণমূল খেলত আজ সেই খেলাই যেন পাল্টা শুরু করেছে বিজেপি।
অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শাসকদল বামপন্থী ও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। গত লোকসভায় কংগ্রেস কোনোমতে দুটি আসন পেলেও বামেরা খাতাই খুলতে পারেনি। এই অবস্থায় কংগ্রেস ও সিপিএম ইতিমধ্যে জোটগতভাবে লড়াইয়ের কথা জানিয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বামপন্থী কিংবা কংগ্রেসের পক্ষে নির্বাচনে জিতে আসার মত বাস্তব পরিস্থিতি এখন আর এ রাজ্যে নেই। তাই তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যেই থাকবে মূল প্রতিযোগিতা।
পাশাপাশি রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের কর্মকান্ডে রাজ্যবাসীর একাংশের মোহভঙ্গ হয়েছে। বিগত পঞ্চয়েতসহ লোকসভা নির্বাচনেও জালভোট, ভোটকেন্দ্রে অশান্তি ও প্রার্থী দিতে না দেওয়ার মতো একাধিক অভিযোগ উঠেছে শাসকদলের বিরুদ্ধে। ঠিক যে কারণে বাম শাসনের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিল মানুষ অনেকটা সেই একই অভিযোগ উঠছে তৃণমূল শিবিরের বিরুদ্ধে। মমতা বিরোধী এই ভোটব্যাঙ্ককেই কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি। সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের ওপর ভর করে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক তৈরির ওপরও জোর দিচ্ছে গেরুয়া শিবির। ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় এখন তাই তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে সবচেয়ে বড় পরীক্ষা সরকার বাঁচানোর৷ কারণ, ২০১৯ লোকসভার পর বিজেপি তাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে৷ সকল সমীকরণ মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তাই একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলেই অভিমত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের।