একুশের ভোটের আগে যারা শিবির বদল করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী ব্যতিক্রম বলা যায়। যেখানে তৃণমূল থেকে আসা একের পর এক নেতা গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়ে ভোট ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়েছেন সেখানে নন্দীগ্রামে শুভেন্দু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়েছেন। এখানেই শেষ নয় রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলনেতার সম্মানও তাঁকে দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই মত, বহুদিন পর বিধানসভায় এক জাদরেল বিরোধী দলেনেতাকে পাওয়া গেছে। একুশের ভোটের পর থেকে যখন তৃণমূলে ঘর ওয়াপসির ঝড় উঠেছে তখন বিরোধী শিবিরে সবচেয়ে সক্রিয় পাওয়া গেছে শুভেন্দুকেই। এমনকি তাঁর ঔজ্বল্যে অনেক জায়গায় বিজেপি রাজ্য সভাপতিও ম্রিয়মান হয়ে গেছেন। দিল্লির গুডবুকেও রয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ প্রত্যেকেই রাজ্যের পরিস্থিতি জানতে শুভেন্দুকেই তলব করছেন। গেরুয়া শিবিরে বিরোধী দলনেতার এই সক্রিয়তাই এখন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করছে। নাম না করে তাঁকেই তোপ দাগছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খাঁর মত নেতারা। তৃণমূল শিবিরে একসঙ্গে কাজ করার পর গেরুয়া শিবিরেও একাধিকবার একমঞ্চে দেখা গেছে তাঁদের। তাহলে আজ কেন পুরনো সতীর্থদের মধ্যে এই দূরত্ব?
একুশের ভোটের পর থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে আর দেখা যাচ্ছে না রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে। গত দেড় মাসে বিজেপির কোনও বৈঠকে হাজির না হলেও একাধিক তৃণমূল নেত্রীত্বের বাড়িতে দেখা গেছে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যাকে। এর মাঝেই দু'বার সোশ্যাল মিডিয়ায় বিস্ফোরক পোস্ট করেছেন ডোমজুড়ের প্রাক্তন বিধায়ক। যেখানে স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তিনি নিশানা করছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ককেই। সাম্প্রতীকি পোস্টে রাজীব লিখেছেন, ‘বিরোধী নেতাকে বলব, যাঁর নেতৃত্বে ও যাঁকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চেয়ে বাংলার মানুষ ২১৩টি আসনে তাঁর প্রার্থীদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন সেই মুখ্যমন্ত্রীকে অযথা আক্রমণ না করে সাধারণ মানুষের দুর্দশা মুক্তির জন্য পেট্রোল, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের মূল্য হ্রাস করাই এখন একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত।’ এর আগেও যখন রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি নিয়ে বিজেপির মধ্যে রব উঠেছিল, তখনও ফেসবুকে পোস্ট করে শুভেন্দুর অবস্থানের বিরোধিতা করেছিলেন রাজীব।
শুভেন্দুকে নিয়ে সম্প্রতী নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বিষ্ণুপুরের বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁও। শুভেন্দু বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর এই সৌমিত্রর হাত ধরেই কাঁথিতে রোড শো করেছিলেন নন্দীগ্রামের ভূমিপুত্র। সেই সৌমিত্রই এখন রীতিমতো ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন শুভেন্দুর উপর। গত বুধবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা রদবদলের দিন বোমা ফাঁটিয়েছিলেন সৌমিত্র। রাজ্য বিজেপি যুব মোর্চার সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ফেসবুকে পোস্ট করে জানান সৌমিত্র। বিজেপিতে আছি, বিজেপিতেই থাকব বলেলও সেদিন কার্যত শুভেন্দুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ। লাইভে এসে সৌমিত্র সেদিন বলেছিলেন, ‘দল এক কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। দিল্লিতে বারবার গিয়ে উল্টো কথা বলা… তিনি একমাত্র আত্মত্যাগ করেছেন, আর কেউ করেননি, এমন না। যেভাবে অধিকার অধিকার করছে, অধিকারী অধিকারী করছে, তাতে আমি হতাশ। যিনি বিরোধী দলনেতা হয়েছেন, তাঁকে বলব, আয়নাতে মুখ দেখুন। আপনার চেয়ে আমাদের আত্মত্যাগ কম নয়।’
এটা ঠিক তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে শিবিরে যাঁরা যোগ দিয়েছেন আজ পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে হইচই হয়েছে শুভেন্দুকে ঘিরেই। এমনকি এটাও বলা হয় জুনিয়র শুভেন্দুকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়াতেই মনক্ষুন্ন হয়ে তৃণমূলে ফিরে গিয়েছেন মুকুল রায়। এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত, সৌমিত্র খাঁ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে দিল্লিতে গিয়ে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নড্ডার সঙ্গে সৌমিত্রর সাক্ষাৎ সেই জল্পনাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল তাই বাংলা থেকে মন্ত্রিদের নাম ঘোষণা হতেই ঠাঁই না পেয়ে নিজের ক্ষোভ উগরেছেন সৌমিত্র। আর সেখানে নিশানা করেছেন শুভেন্দুকেই। কারণ, তাঁর থেকে পরে বিজেপিতে এলেও মোদী-শাহদের সুনজরে থাকার ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছেন নন্দীগ্রামের বিধায়ক। অন্যদিকে ভোটের আগে বিজেপিতে গিয়ে সুবিধে করতে পারেননি রাজীব। দু'বারের বিধায়ককে এবার শোচনীয় ভাবে হারতে হয়েছে ডোমজুড়ে। তারপর থেকেই গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে রাজীবের। নির্বাচনী হারের পর দলে যে আর গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পাওয়া সম্ভব নয় তা জানেন রাজীবও। এই অবস্থায় তিনি যেকোন মূল্যে পুরনো দলে ফিরতে চাইছেন বলেই মত ওয়াকিবহাল মহলের। কিন্তু তাঁকে দলে নিতে এখনও গ্রিন সিগন্যাল দেননি তৃণমূলনেত্রী। এই আবহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যাকে খুশি করতেই রাজীব শুভেন্দুকেই নিশানা করছেন এমন সম্ভাবনাও কিন্তু একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।