(১) নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মালাক্কা প্রণালীর দিকে ঘুরে আসা সাইক্লোন ‘সেন্যার’ নিয়ে প্রথমে কেউই বড় বিপদের আশঙ্কা করেনি। কিন্তু সমুদ্রপথ থেকে স্থলে আসতেই ঝড় এমন তাণ্ডব চালিয়েছে যে মুহূর্তে ভেস্তে গেছে সুমাত্রার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।
(২) উত্তর সুমাত্রায় টানা তিন দিন ধরে প্রকৃতির খড়্গ নেমে আসে। পরপর দিনভর ঝরেছে মুষলধারায় বৃষ্টি। একদিনেই জমেছে প্রায় ১৬ ইঞ্চি বা ৪০ সেন্টিমিটার জল যা সেখানকার জন্য অস্বাভাবিক।
(৩) এই প্রবল বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলের চাপে রাতারাতি বহু গ্রামের অস্তিত্বই মুছে গেছে। কাদা, পাথর আর জলের স্রোতে ভেসে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে ৮৩৬ জনের, এখনও ৫১৮ জন নিখোঁজ। আহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২৭০০-র গণ্ডি।
(৪) শুধু জল নয়, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল ঢলের সাথে আসা বিশাল কাঠের বোল্ডার বা গাছের কাণ্ড। হাজার হাজার লগ পাহাড় থেকে নদীতে নেমে এসে ঘরবাড়ি ভেঙে দিয়েছে রাক্ষুসের মতো। অনেককে আটকেও ফেলেছে কাদার তলায়।
(৫) উত্তর সুমাত্রার তুক্কা জেলার উদ্ধারকর্মীদের কথায়, রাস্তার দুই পাশে চোখে পড়েছে শুধু কাঠ আর ধ্বংসস্তূপ। সেই কাঠই ঘরবাড়ি ভেঙে সব শেষ করে দিয়েছে।” স্থানীয়রা বলছেন, এমন বিপর্যয় তারা কোনোদিন দেখেননি।
(৬) বিজ্ঞানীদের মতে, এই ধ্বংসযজ্ঞের নেপথ্যে মূল ভূমিকা ‘সেন্যার’-এর নয়, বরং টানা তিন দশকের লাগামছাড়া জঙ্গলে গাছ কাটার ফল।পাহাড়ে গাছ কেটে পাম অয়েল চাষের জন্য বন উজাড় হওয়ায় প্রকৃতির রক্ষাকবচ হারিয়েছে সুমাত্রা।
(৭) বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা—একটি পূর্ণবয়স্ক গাছ দিনে ৫০০-১০০০ লিটার জল শোষণ করে। বন থাকলে বৃষ্টির ৩০-৪০ শতাংশ জল মাটিতেই থেকে যেত। কিন্তু বন না থাকায় পাহাড়ি ঢল সরাসরি নেমে এসেছে নদীতে, ফলে তীব্র ফ্ল্যাশ-ফ্লাড তৈরি হয়েছে।
(৮) জঙ্গল কাটা বন্ধ না হওয়ায় পাহাড়ের মাটি আলগা হয়ে গেছে। ফলে সামান্য জলের চাপেই ভয়ানক ভূমিধস নেমেছে। অনেক গ্রাম একদমই মাটির নিচে দাফন হয়ে গিয়েছে।
(৯) ৩৫ বছরের পরিসংখ্যান ভয় ধরায়, ১৯৮৫ সালে সুমাত্রার ৬০% ছিল ঘন রেনফরেস্ট। ২০০০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৮%-এ। আজ ২০২৫ সালে জঙ্গল টিকে আছে মাত্র ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ ৪০ বছরে উধাও ৭৪ শতাংশ বনাঞ্চল।
(১০) শুধু তাই নয়, প্রতি বছর সুমাত্রায় গড়ে ৫-৬ লাখ হেক্টর বন কাটা হচ্ছে।নযা ভারতের দিল্লির দ্বিগুণ এলাকার সমান। এই মৃত গাছগুলিই পাহাড়ে পড়ে থাকে, আর ভারী বৃষ্টিতে সেগুলো জলের ধাক্কায় নীচে নেমে এসে ধ্বংস বাড়ায়।
(১১) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলেও ‘সেন্যার’-এর দাপট বেড়েছে। ভারত মহাসাগরে বাড়ছে তাপমাত্রা, বাষ্প ও আর্দ্রতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় ২০-৩০ শতাংশ বেশি।
(১২) লা-নিনার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলীয় অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। জঙ্গল না থাকায় অতিরিক্ত জল পাহাড়ে আটকে না থেকে গড়িয়েছে গ্রামগুলোর দিকে। সে কারণেই আছেহ প্রদেশে মাত্র একদিনেই পুরো ৪টি গ্রাম উধাও হয়ে যায়।
(১৩) উত্তর সুমাত্রার বাটাং তোরু এলাকায় কাঠের স্রোত ভেঙে দিয়েছে শতাধিক বাড়ি। পশ্চিম সুমাত্রার মালালাকে ভূমিধস চাপা দিয়েছে বহু জনবসতি। পরিবেশবিদরা বলছেন, এটি ছিল ‘ম্যান-মেড ডিজাস্টার’, যার দায় পুরোটা মানুষের উপরই।
(১৪) সতর্কবার্তা দিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনই বন উজাড় বন্ধ না করলে আগামী ৫ বছরের মধ্যেই সুমাত্রার বাকি সব বনও শেষ হয়ে যাবে। তাতে ভবিষ্যতের ঝড় আরো ভয়াবহ হবে, এবং প্রতি বছরই এমন বিপর্যয় নেমে আসবে।
(১৫) ইন্দোনেশিয়া সরকার ইতিমধ্যে অঞ্চলটিকে জাতীয় জরুরি অবস্থার ঘোষণা করেছে। নতুন করে বনরোপণ, নদীর ধারে বাফার জোন তৈরি এবং ঝুঁকিপূর্ণ গ্রামগুলোকে পুনর্বাসনের কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে পরিবেশবিদদের সতর্ক বার্তা, প্রকৃতিকে লুট করার মূল্য এখন গোটা বিশ্বই দিচ্ছে, এবং সময় থাকতে না থামলে ক্ষতির পরিমাণ আর ফেরানো যাবে না।