আরজি কর হাসপাতালে (RG Kar Hospital Case) মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ- খুনের ঘটনার জেরে এখনও ধুন্ধুমার শহর- শহরতলি। সুবিচার ও নিরাপত্তার দাবিতে, প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তাররা। তাঁদের কর্মবিরতি চলছে এখনও। গর্জে উঠেছে দেশবাসী। এমনকী প্রতিবাদে সরব হয়েছেন প্রবাসীরাও। ৩১ বছর বয়সী মহিলা চিকিৎসকের মৃত্যুতে সরব সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন বিনোদন জগতের শিল্পী ও কলাকুশলীরাও। সোশ্যাল মিডিয়ায় বা পথে নেমে 'জাস্টিস' (Justice) চাওয়াতেই শুধু থেমে নেই স্টুডিওপাড়া। এবার টলিউডে (Tollywood) কাজের পরিবেশ ঠিক করতে, নিজেদের সুরক্ষার জন্যে কিছু আবেদন নিয়ে চিঠি তৈরি করল উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস (Womens' Forum for Screen Workers+)।
এক দিকে আরজি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদের ঝড়, অন্যদিকে, হেমা কমিটির রিপোর্ট (Hema Committee Report) ঘিরে মালয়ালম চলচ্চিত্র জগতের উত্তাল পরিস্থিতি। টলিপাড়াতেও একের পর এক নারী নিগ্রহের ঘটনা প্রকাশ্যে আসছে। যদিও টলিপাড়ায় এই ধরণের হেনস্থার ঘটনা নতুন নয়। বহু ক্ষেত্রে কোনও মহিলারা এগিয়ে এসে অভিযোগ করতে ভয় পান। আরজি করের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, ২০২৪ সালে এসেও, মহিলাদের অবস্থান ঠিক কোথায়। টলিউডের মহিলা কর্মীরা এবার একজোট হয়ে প্রশ্ন তুললেন 'সিস্টেম'-র বিরুদ্ধে? ইম্পা (Eastern India Motion Picture Association/ EIMPA), আর্টিস্ট ফোরাম (West Bengal Motion Picture Artist Forum), ফেডারেশন (Federation of Cine Technicians & Workers of Eastern India) ও টেলি অ্যাকাডেমির (Tele Academy) চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে এই চিঠি দেওয়া হয়েছে মঙ্গলবার।
বাংলা ইন্ডাস্ট্রির সিনেমা, সিরিয়াল ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে কর্মরত মহিলাদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করা হয়েছে। প্রশ্ন করা হয়েছে, ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে যৌন হেনস্তার অভিযোগ জানানোর জন্য কোনও প্রতিষ্ঠান কি রয়েছে? পকসো আইনের শর্তগুলো কি মেনে চলা হচ্ছে? চিঠিতে লেখা, "প্রত্যেকদিন আমাদের নানা ভাবে যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়। পাশাপাশি নিয়মিতভাবে নারী, শিশু এবং প্রান্তিক পরিচয়ের মানুষদের নির্যাতনের কথাও শোনা যায়। তবুও, আমাদের কাছে এমন কোনও কার্যকরী সহায়তা ব্যবস্থা নেই যেখানে ভারতীয় আইন অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, নিষেধাজ্ঞা এবং প্রতিকারের দাবি জানাতে পারি।"
বাংলা ইন্ডাস্ট্রির মহিলা কর্মীদের অভিযোগ, এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও আলাপ আলোচনা করা হয় না। এছাড়াও ঘনিষ্ঠ দৃশ্যের জন্য যথাযথ ভাবে ইন্টিমেসি কোর্ডিনেটর বা ডিরেক্টর নিয়োগের দাবি জানানো হয়েছে। লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া কথা বলেছেন তাঁরা। এর পাশাপাশি যৌন হেনস্তার অভিযোগ যেখানে জানানো যাবে, এরকম ২৪ ঘণ্টার হেল্পলাইন চালু করার কথাও উল্লেখ রয়েছে।
গত কয়েকদিন ধরেই এই নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দামিনী বেণী বসু (Daminee Benny Basu)। সোশ্যাল মিডিয়াতেও যৌন হেনস্থা নিয়ে সরব হন অভিনেত্রী। বাংলা ডট আজতক ডট ইন-র তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস-র চিঠি প্রসঙ্গে। তিনি বলেন, "এমন নয় যে বিষয়গুলো ঘটছে, সেটা কেউ জানে না। সকলেই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খুলতে পারছে না, কারণ সিস্টেমটাই এরকম। এই সিস্টেমটা আসলে কী? একটা মানুষের মরার পরে আমাদের জাস্টিসের জন্যে গলা ফাটাতে হচ্ছে। একটা গোছানো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মধ্যে এত বড় একটা অপরাধ ঘটল। তাহলে আমাদের মতো যে সেক্টরগুলো অগোছালো, সেখানে কী অবস্থা হয়ে রয়েছে? ওখানে নিয়ম থাকা সত্ত্বেও এই ঘটনা ঘটল। তাহলে যেখানে নিয়মই নেই, সেখানে মানুষের কী অবস্থা? আজ একই জিনিস একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে মেকআপ রুমে যদি হত? এখানে চিকিৎসকদেরই ছাড়া হল না? আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, 'তোমাদের সমস্যা, তোমরা তাহলে বাড়ি থাকো...'। একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে উনি আমাদের পেটে লাথি মারছেন, বলছেন কাজ করার দরকার নেই, বাড়ি থাকো। সেখানে অসংগঠিত সেক্টরগুলোতে অরাজকতা ভরে আছে। এখানে কতটা দুর্নীতি, কতটা জমিদারী, কতটা বাবুর বাগানবাড়ি, আমরা সবটাই জানি।"
বেণী আরও বলেন, "এই মুহূর্তে জাস্টিসের একটাই ভাষা আমি বুঝতে পারছি, যে জিনিসগুলো আইনে রয়েছে, সেগুলোই এখানে অনুপস্থিত কেন? আমরা শুধু এই প্রশ্ন করছি। আমরা নতুন কিছু চাইছি না। এগুলো তো থাকারই কথা। এখানে আর্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি এই দুটো, মানুষ গুলিয়ে ফেলেছে। ধর্ষণ একদিনে হয় না। একটা সমাজ ধর্ষককে তৈরি করে। এগুলো পিতৃতন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে। আমরা শিখছি কীভাবে শিকলটা ভেঙে বেরিয়ে আসেত হয়। জানি এই লড়াইটা কঠিন। একেবারেই সহজ হবে না। ও আগে কেন করেনি, ও কেন এটা করেনি, এসব নিয়ে এখন আঙুল তোলার সময় না। একটি মেয়ে চলে গিয়ে সবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় কোথায় ঘুনগুলো রয়েছে।"
অভিনেত্রী যোগ করেন, "দু'দিন আগেই স্বরূপ বিশ্বাস বড় মুখ করে বলেছেন, এরকম কোনও কথা এখনও অবধি নাকি কেউ ওদের জানায়নি। যদি জানায়, তাহলে নাকি তিনি এর শেষ দেখে ছাড়বেন। শেষ দেখার এখন একটাই উপায়, সেটা হল নিয়ম। আর আমি বেঁচে থেকে 'জাস্টিস' পেতে চাই। এই জন্যে আমরা সময় চেয়েছি প্রশ্নগুলো তুলে। আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি, কাজ করব। এগুলো তো আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে না। এবার দেখা যাক...কী শুনি আমরা ওদের থেকে।"
শ্রীলেখা মিত্র উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস-র এই চিঠিকে 'আইওয়াশ' বলে মন্তব্য করেছেন। অভিনেত্রী বলেন, কিছু বছর আগে তিনি যখন এই অভিযোগ তুলেছিলেন, কেউ সমর্থন করেননি তাঁকে। এই প্রসঙ্গে বেণী বলেন, "শ্রীলেখার এরকম প্রতিক্রিয়া দেওয়ার ১০১ শতাংশ অধিকার আছে। কারণ শ্রীলেখার একবার নয়, দু'বার নির্যাতন হয়েছে। একবার ও নির্যাতিত হয়েছে, আর একবার এটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবার নির্যাতিত হয়েছেন। এই ট্রমা একদিনে যায় না। ওঁর পাশে তখন কে দাঁড়িয়েছিল? আর কে দাঁড়াবে? যেই এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাঁর কাজ চলে গেছে। আমার ওঁর প্রতি সহানুভূতি রয়েছে। আন্দাজ করতে পারি ওঁর উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে।"
প্রসঙ্গত, উইমেনস ফোরাম ফর স্ক্রিন ওয়ার্কার্স প্লাস-র চিঠিতে যেমন রয়েছে অপর্ণা সেন, শাশ্বতী গুহঠাকুরতা, অনুরাধা রায়, শকুন্তলা বড়ুয়া, চৈতালী দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, রূপা গঙ্গোপাধ্যায়, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, দামিনী বেণী বসু, স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, প্রিয়াঙ্কা সরকার, পাওলি দাম, সোহিনী সরকারের মতো অভিনেত্রীদের নাম। তেমনই রয়েছে ইন্ডাস্ট্রির অন্যান্য বহু মহিলা কলাকুশলীদের নাম।