প্রদোষ চন্দ্র মিত্র ওরফে 'ফেলুদা', সত্যজিৎ রায় সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যের এই জনপ্রিয় কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র, বাঙালির 'হিরো' বললে ভুল হবে না। বইয়ের পাতায় তো বটেই, বড় পর্দা থেকে ওটিটি-তে 'ফেলুদা' বরাবর হিট। বড়দিনে ফেলুদাপ্রেমীদের জন্য দারুণ উপহার দিয়েছেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়। হইচই-তে স্ট্রিমিং হচ্ছে 'ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি ২: ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর'। আবারও ফেলুদা রূপে সকলের মন জয় করেছেন টোটা রায়চৌধুরী। ফের ফেলুদা হয়ে ওঠার জার্নি থেকে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বাংলা ডট আজতক ডট ইন-এর সঙ্গে টেলিফোনে আড্ডা দিলেন টোটা।
প্রশ্ন: আবার ফেলুদা রূপে, নতুন গল্পে। নিশ্চয় খুব উৎসাহিত?
টোটা: আমি ভীষণ এক্সাইটেড। ফেলুদা আসলেই আমার উত্তেজনার পারদ আরও চড়তে থাকে সব সময়। মনে হয়, আমার শৈশব, স্বপ্নকে উদযাপন করছি। কারণ এটা এমন একটা চরিত্র, যেটার পিছনে আমার তীব্র আকাঙ্খা, লোভ ছিল, আছে এবং থাকবে।
প্রশ্ন: মুক্তির সময় বা পরে শুধুই কি উত্তেজনা নাকি কিছুটা টেনশনও থাকে?
টোটা: টেনশন তো অবশ্যই কাজ করে। কারণ যে দর্শকেরা প্রথম থেকেই আমাদের সঙ্গে ছিলেন, যারা একদম প্রথম থেকেই আমাদের মেনে নিয়েছিলেন, তাদের কথা সব সময় মাথায় থাকে। মনে ভয়টা থাকে শুধু একটাই কারণে, আমরা যেন তাদের হতাশ না করি।
প্রশ্ন: আগের ফেলুদার গল্প সফল হওয়ায়, দায়িত্ব কি একটু বেড়েছে?
টোটা: অবশ্যই। দায়িত্ব প্রতিবারই থাকে। তবে এবার একটু বেশি ছিল কারণ, আমাদের প্রযোজক এবার অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করেছেন। তাই চাই এত মানুষ দেখুক, যাতে ওদের মনে হয় এতটা বিনিয়োগ করা স্বার্থক হয়েছে।
প্রশ্ন: সৃজিত মুখোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন, আর ফেলুদার সিরিজ বানাবেন না। খারাপ লেগেছে?
টোটা: ভীষণ- ভীষণ খারাপ লাগছে। কারণ, সৃজিত ছাড়া কেউ আমায় ফেলুদা হিসাবে ভাবতে পারেনি। যদিও কয়েকজন দর্শক ভেবেছিলেন। ও আমায় শুধু ফেলুদা তৈরি করেনি, লোকের কাছে গ্রহণযোগ্য করেছে। সেক্ষেত্রে ও আর ফেলুদা বানাবে না শুনে আমি এতটাই হতাশ যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি। ওঁকে আমরা বারবার অনুরোধ করছি, যাতে বিষয়টা আবার বিবেচনা করে। এখন দেখি এই সিদ্ধান্তটা মানুষ কীভাবে গ্রহণ করে। এরপর সেই অনুযায়ী, ওঁর সঙ্গে আবার কথা বলব।
প্রশ্ন: বড় পর্দায় ফেলুদা বানানোর স্বত্ব তো শুধুই সন্দীপ রায়ের আছে...
টোটা: হ্যাঁ শুধুমাত্র বাবুদার (সন্দীপ রায়) আছে। এবার উনি যদি কয়েকটা স্বত্ব আমাদের দেন বড় পর্দায় তৈরি করার জন্য, তাহলে হয়তো সৃজিত আবার ফেলুদা বানাবে। আসলে, যে জায়গায় সৃজিত ফেলুদাকে, অন্তত 'ভূস্বর্গ ভয়ঙ্কর'কে নিয়ে গিয়েছে, তাই আমরা চাইব পরেরটা আরও বড় স্কেলে হোক। আমি বোম্বেতে ট্রেলারটা কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলাম। তাঁরা দেখে চমকে গিয়েছিল, এত বড় স্কেলে কাজ হয়েছে বলে। যেহেতু এই কাজটা অনেকটা ব্যয় সাপেক্ষ, সেই টাকাটা ওটিটি-র জন্য তোলা সম্ভব না। শুধুমাত্র সিনেমা করেই তোলা যায়।
প্রশ্ন: ফেলুদা সিরিজের জন্য যদি অন্য কোনও পরিচালক আপনাকে প্রস্তাব দেন, রাজী হবেন?
টোটা: এই মুহূর্তে আমি সেরকম ভাবনা-চিন্তা করিনি। আসলে ভাবতেই পারছি না সৃজিত ছাড়া কেউ ফেলুদা পরিচালনা করছেন, যেখানে আমি ফেলুদা।
প্রশ্ন: আপনি হিন্দি সিরিজেও কাজ করছেন। বাজেট ছাড়া দুই ইন্ডাস্ট্রির কতটা তফাৎ বুঝতে পারেন?
টোটা: বাজেটটাই সবচেয়ে বড় তফাৎ। কারণ বাজেট বড় হলে, কাজের দিন বেড়ে যায়। তখন কাজটা আরও একটু ধরে করা যায়। একটা চরিত্র নিয়ে ভাবার বা নতুন কিছু চেষ্টা করার অনেকটা সময় পাওয়া যায়। আমরা কাজের জন্য হাতে সময় পাচ্ছি ১৫ দিন। অথচ এর মধ্যেই আমায় এর গুণগত মান বজায় রাখতে হচ্ছে, ফেলুদা সুলভ অভিনয় করতে হচ্ছে। অসম্ভব চাপ নিতে হয়।
প্রশ্ন: সময় নিয়ে এই অভিযোগ তো বারবার বিভিন্ন অভিনেতার মুখেই শোনা যাচ্ছে...
টোটা: এটা না বাড়ালে খুব অসুবিধা। আমরা ভাল কাজ জানি। বাঙালি শিল্পীদের কম দিয়েই বেশি করার যোগ্যতা রয়েছে শুরু থেকেই। পঞ্চাশ- ষাটের দশক থেকেই এগুলো হয়ে আসছে। সত্যজিৎ রায়ের ছবি নির্মাণ দেখে তো হলিউডেরও চোখ প্রায় কোটর থেকে বেরিয়ে আসে। এই সরঞ্জাম, কাঠামো দিয়ে কী করে এত ভাল ভাল ছবি নির্মাণ করা সম্ভব, তা ওরা ভাবতেই পারে না। আমরা বিশ্বাসযোগ্যভাবে করে দিতে পারব। কিন্তু যে চাপটা আমায় এখানে নিতে হয়, সেই চাপটা হিন্দি কাজের ক্ষেত্রে নিতে হয় না। কারণ আমি জানি অনেক বেশি দিন পাওয়া যাবে। একটা দৃশ্য আমার পছন্দ না হলে, বলতে পারি এই জায়গাটা আরেকবার করো। এখানে আমরা পনেরো দিন পাচ্ছি একটা দেড়শো মিনিটের সিরিজ শ্যুটের জন্য। আর ওখানে, তিনশো মিনিটের সিরিজের জন্য পাওয়া যায় প্রায় সত্তর দিন। ওদের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ বাজেট আমরা পেলে, যা তৈরি করে দিতাম, তা কল্পনা করতে পারবে না কেউ।
প্রশ্ন: কাশ্মীরে শ্যুটিং। সত্যিই তো ভূস্বর্গ! কাজ করার কেমন অভিজ্ঞতা হল?
টোটা: এরকম সুন্দর জায়গা তো ভারতবর্ষে আর নেই। কাশ্মীরে শ্যুটিং করে এমন একটা অনুভূতি নিয়ে ফিরেছি, যেটা বহু বছর সঙ্গে থাকবে।
প্রশ্ন: এত ঠান্ডার মধ্যে শুধুমাত্র ব্লেজার পরে কীভাবে শ্যুটিং করলেন?
টোটা: করতে হয়েছে কারণ ফেলুদা এটা। সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে কোনও অভিযোগ করলে ওঁর একটাই ডায়লগ, 'ফেলুদা সব পারে...।'
প্রশ্ন: আপনার প্রিয় গোয়েন্দা কে?
টোটা: ফেলুদা।
প্রশ্ন: এই চরিত্রে অভিনয় করলেন বলে বলছেন?
টোটা: না ছোটবেলা থেকে ফেলুদাই প্রিয় আমার। সাত বছর বয়সের জন্মদিনে 'বাদশাহী আংটি' বইটা উপহার পেয়েছিলাম, সেখান থেকে আমার ফেলুদা-প্রীতি শুরু।
প্রশ্ন: হিন্দি, বাংলায় এতগুলো মাধ্যমে কাজ করছেন বর্তমানে। মাঝে খুব কম কাজ করছিলেন। ইন্ডাস্ট্রিতে কারও উপর অভিমান আছে?
টোটা: না আমার এখন আর কোনও অভিমান নেই। তার কারণ আমি মনে করি, এটা এমন একটা জার্নি যেটা পূর্ব নির্ধারিত। আমাদের কাজ হচ্ছে হেঁটে যাওয়া। বসে বা থেমে থাকলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন: তারকা ও বিতর্ক প্রায় সমার্থক। আপনাকে নিয়ে বিতর্ক শোনাই যায় না...এই ভাবমূর্তিটা বজায় রাখা কতটা কঠিন?
টোটা: এটা কঠিন না। প্রায়োরিটি ঠিক থাকলে, এবং কিছু কিছু বিষয়ে খুব কঠোর থাকলে, কোনটা করব আর কোনটা করব না জানলে, এটা একদমই কঠিন না। আমি অভিনয়টা করি, এটাই করব। আমি করতে অনেক কিছুই পারি, কিন্তু সহজভাবে বলতে গেলে, অভিনয় ছাড়া আর কিছু করতে চাই না। আমি এমন কিছু করতে চাই না যেটা করে আমার মূল লক্ষ্য থেকে নজরটা সরে যায়।
প্রশ্ন: অন্যান্য তারকাদের ট্রেন্ডে গা ভাসাতে দেখা যায় নেটমাধ্যমে। আপনাকে সেসব করতে দেখা যায় না...
টোটা: সোস্যাল মিডিয়া একটা সম্পূর্ণ আলাদা মাধ্যম। সেটা করার মতো আমার সেই আকর্ষণ বা সক্ষমতা নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রাসঙ্গিক হতে গেলে এক ধরনের ট্যালেন্ট লাগে। সেটা আমার নেই।
প্রশ্ন: আপনার নাচের দৃশ্য এখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছে। 'রকি অউর রানি কি প্রেমের কাহানি'-তে এত প্রশংসা কুড়িয়ে, নাচ নিয়েই কোনও কাজ করার ভাবনা-চিন্তা বা ইচ্ছে আছে?
টোটা: বহু বছর ধরেই আমার ইচ্ছে নাচ নিয়ে কোনও ছবি করার। তার কিছুটা পূর্ণ হয়েছিল 'রকি অউর রানি কি প্রেমের কাহানি'-তে। আমার এখনও ইচ্ছে আছে। নাচটা খুব সংবেদনশীলতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে হবে এবং উপস্থাপনা করতে হবে পর্দায়। সেরকম কোনও গল্প যদি থাকে, আমি এক পায়ে খাড়া।
প্রশ্ন: তার মানে দর্শকের এই ইচ্ছে পূর্ণ হতে পারে?
টোটা: দর্শক চাইলে, ওরা যদি সমবেতভাবে বলেন কর্তৃপক্ষকে, তাহলে নিশ্চয় কেউ না কেউ এরকম একটা ছবি তৈরি করার চিন্তা-ভাবনা করবেন। আমি একেবারে রাজি এরকম ছবিতে কাজ করতে।