scorecardresearch
 

'পুরীর রথযাত্রার ডায়েরি' পর্ব ৫: কোথাও একটা বাঙালি সম্পর্কে এখানে অজানা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে

এখন যেমন পুরী কেন, গোটা ওড়িশাজুড়ে চলছে বলভদ্রের কাষ্ঠমূর্তি পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে তুলকালাম। বিজেপি বনাম বিজেডি-র দোষারপের রাজনীতিও তো শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপি বলছে, সবই প্রভুর লীলা। পড়ে যাওয়াও লীলা। আবার তেমন বড় দুর্ঘটনা না ঘটাও লীলা।

Advertisement
Puri Ratha Yatra 2024 Puri Ratha Yatra 2024
হাইলাইটস
  • বলভদ্রের কাষ্ঠমূর্তি পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে তুলকালাম
  • বহু পাণ্ডাদের তো বিশাল বিশাল ভুঁড়ি দেখছি
  • জয় জগন্নাথের টি-শার্ট খুব বিক্রি হচ্ছে

আজ সকালবেলায় ঘুম ভাঙল মোরগের ডাকে। কক্কর কক্কর করে সে ডেকে চলেছে। এই মোরগটি প্রতিদিন নানা সময় তারস্বরে ডাকে। প্রথমে মনে হত, ও বোধহয় ওর সঙ্গীর ঘুম ভাঙাচ্ছে বা অন্যদের ডাকছে। বলছে, সকাল হল। আবার দুপুরে যখন ডাকত তখন মনে হত, ওর বোধহয় খিদে পেয়েছে, তাই ডাকছে। এখন বেশ কয়েকদিন কেটে যাওয়ার পর মনে হচ্ছে, বিভিন্ন প্রহরেই ও ডাকে। ওর ডাক শুনে যেন ঘড়ি মেলানো যায়। রথযাত্রার দিনগুলিতে পুরীতে এসে নানা রকম অভিজ্ঞতা। কতরকমের মানুষ! কত বিচিত্র এ জীবন! সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দ, সাদা-কালো— সব নিয়েই তো আমাদের জীবন। ভিড়, ঠেলাঠেলি, মারামারি, চিৎকার-চেঁচামেচি, টোটো আর অটো রিক্সার হর্নের আওয়াজ। আবার তারই মধ্যে সম্রদ্র সৈকতের নির্জন অন্ধকারে অসাধারণ সুষুপ্তি।

এখন যেমন পুরী কেন, গোটা ওড়িশাজুড়ে চলছে বলভদ্রের কাষ্ঠমূর্তি পড়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে তুলকালাম। বিজেপি বনাম বিজেডি-র দোষারপের রাজনীতিও তো শুরু হয়ে গিয়েছে। বিজেপি বলছে, সবই প্রভুর লীলা। পড়ে যাওয়াও লীলা। আবার তেমন বড় দুর্ঘটনা না ঘটাও লীলা। আরও ভয়ঙ্কর তো হতে পারত। কত মানুষ মারা যেতে পারত। প্রভুই তো রক্ষা করেছেন। আবার প্রভু পড়ে গেলেন কেন? নিশ্চয়ই কোনও গূঢ় অর্থ আছে। এমন ঘটনা তো এর আগে হয়নি। অন্যদিকে বিজেডি নেতানেত্রীরাও অভিযোগ করছে অব্যবস্থার। তারা বলছে, এর দায় কে নেবে? কেন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি? জেলাশাসকের দায়িত্ব ছিল, প্রশাসনের দায়িত্ব ছিল। পুরীর মহারাজা হলেন জগন্নাথ ধামের এবং রথযাত্রা কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি দুঃখপ্রকাশ করেছেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁর কি কোনও দায় নেই? তিনি তো প্রথম সেবক। তাঁর ভূমিকা কী?
  
মেগাস্থিনিস থেকে হিউয়েন সাং, যারই ভারত পরিক্রমার ডায়েরি পড়েছি, দেখেছি তারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের নৃতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণ করতেন। অর্থাৎ, সেখানকার মানুষরা— তারা কীরকম দেখতে, তাদের গড়ন, তাদের প্রকৃতি। ওড়িশার মানুষদের আমি খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করছিলাম। রথযাত্রার ভিড় থেকে সমুদ্র সৈকত, এমনকি জগন্নাথের প্রধান মন্দিরের বাইরে সুবিস্তৃত পরিসর। আর এখন তো আরও নতুন নতুন নির্মাণ হয়েছে, অসাধারণ আলপনা। তার ওপর লাল মেঝে। চারদিক বড় মনোরম। আজ সন্ধ্যায় এসেছি মন্দিরের বাইরের যে বিশাল একটা চত্বর, সেখানে দেখছি এখানকার স্থানীয় মানুষেরা অনেকে এমনিই মন্দিরের এই জায়গায় আসেন, ঘুরে বেড়ান। একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। এখানকার মানুষেরা, তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে পুরুষেরা অনেকেই বেশ গাট্টাগোট্টা। অনেকের বিশাল ভুঁড়ি আছে। হয়তো ভাত খেয়ে তাদের এই ধরনের ভুঁড়ি হয়েছে। বহু পাণ্ডাদের তো বিশাল বিশাল ভুঁড়ি দেখছি। কিন্তু এঁরা আবার খুব পরিশ্রমী। তাঁদের গায়ের রং বেশিরভাগই সমুদ্রের ধারে গড়ে ওঠা মানুষের রং; অর্থাৎ, খুব ফর্সা গায়ের রং দেখাই যায় না। আবার মেয়েদেরও ওড়িশা এবং বিহারের মধ্যে তফাৎ করা যায়। তাদের বেশিরভাগেরই গায়ের রং মেটে। ট্র্যাডিশনাল মানুষজন বেশি। আর ওড়িশার যে প্রিন্ট, সেই কটকি প্রিন্ট খুব জনপ্রিয়।
 
জগন্নাথ দেবের প্রসাদও অনির্বচণীয়, স্বর্গীয়! জগন্নাথের মূল মন্দির থেকে স্বর্গোদ্বার নিয়ে ছোটবেলার অনেক স্মৃতি। সেই রাস্তা আগে সরু গলির মতো ছিল। দু’ধারে রকমারি দোকান। এখন অবশ্য দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে গেছে। মন্দির থেকে স্বর্গদ্বার যাওয়ার যে রাস্তা, সেটা তো চেনাই যায় না। বিরাট করিডর তৈরি হয়েছে। তারপর সেই করিড়র দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্বর্গদ্বারে যে খাদিগলি, সেই গলিতে আপনি এসে পৌঁছবেন। সেই স্বর্গদ্বারের বাজার থেকে ভারত সেবাশ্রম সংঘ হয়ে পৌঁছে যাবেন শ্রীচৈতন্য দেবের ঐতিহাসিক দু-হাত ছড়ানো মূর্তির কাছে। আর তারপরেই সমুদ্র। যাচ্ছি স্বর্গদ্বার দিয়ে। নানা রকমের পসরা নিয়ে দোকানিরা বসে আছেন। অনেক রকমের শঙ্খ, যেগুলো পাশের সমুদ্র থেকে তোলা। নানা রকমের রত্ন, সিঁদুর, শুকনো প্রসাদ, জিবেগজার দোকান নৃসিংহ সুইটস। শুধু জিবেগজা যে কতরকমের দেখতে হয় সেটা এখানে না এলে বোঝা যায় না। লাল এবং রানি রঙের ছোট ছোট, লম্বা লম্বা মহাপ্রসাদের পুটুলি বিক্রি হচ্ছে, যেগুলো দেখতে অনেকটা কোলবালিশের মতো। তাতে আছে শুকনো মহাপ্রসাদ।
 
এখানকার মানুষেরা গড়পরতা কিন্তু সৎ। মানে, সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ সৎ। তবে অসৎ-দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ তো থাকবেই। এটা যে পৃথিবীর নিয়ম। সাধারণ গরিব মানুষ খুব ধর্মভীরু। একজন রিকশাওলাকেও যদি বলা হয়, দেখেছো তো, বলরাম রুষ্ঠ হয়েছেন। তিনি পড়ে গেছেন। চিটিং কোরো না। ন্যায্য পয়সা নাও। তাতে দাঁত বের করে হেসে সেই রিকশাওয়ালা বললেন, না না, পাপ হবে। যা আপনার মনে হয়, তাই দেবেন। এমন রিকশাওয়ালাও কিন্তু আমি অনেকজনকেই পেয়েছি। এখানকার আর একটি মিষ্টি হচ্ছে মোহনভোগ। এছাড়া রসগোল্লা তো আছেই। ওড়িশার দাবি, রসগোল্লা তাদেরই আবিষ্কার। সে যাই হোক, অনেকে বলে, রসগোল্লা না বাংলার, না ওড়িশার। আসলে রসগোল্লা তৈরি করেছে পর্তুগিজরা কলকাতায় এসে। এখানে দেশি ঘিয়ের খাজাও খুব বিখ্যাত। আর আছে মালপোয়া। স্বর্গদ্বারের বিভিন্ন দোকানের মধ্যে মিষ্টির দোকানের আধিপত্য অনস্বীকার্য। পুরী ধামের এই অসাধারণ অনির্বচণীয় চরিত্র অনুভব করতে করতে চলেছি সমুদ্রের দিকে।
 
আমাদের ছোটবেলায় পুরী আসার স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা রকমের কাঠের খেলনা। ছোটবেলায় শুধু জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার কাঠের মূর্তি নয়, আরও নানা রকমের কাঠের রেলগাড়ি থেকে শুরু করে কাঠের পুতুল এবং আরও কতকিছু বিক্রি হত। এখন এবারে দেখছি, ছড়ি আর কাঠের খেলনা— এই দুটোই অনেক কমে গেছে। ছড়ির চোকান পেলাম, কিন্তু এরকম বাঙালি খুব কম আছে, যারা পুরী থেকে ফিরেছেন কলকাতায়, একটা ছড়ি না কিনে। আর মেয়েদের ব্যাগের দোকান তো ভারতের যেকোনও শহরেই, যেকোনও সাধারণ বাজারে দেখা যায়ই। মেয়েদের পছন্দের একটা বিষয় হল, নানা ধরনের ব্যাগ। এখানেও উড়িষ্যার নিজস্ব শিল্পমন্ডিত নানা রকমের ব্যাগ তো চিরকালীন। সে তো ছিল, আছে এবং থাকবে। 

Advertisement

হাঁটছি স্বর্গদ্বার দিয়ে। সমুদ্রের হাওয়া মুগ্ধ করছে। মোহিত করছে মানুষকে। জয় জগন্নাথের টি-শার্ট খুব বিক্রি হচ্ছে। মনে মনে ইচ্ছে হল, ১৮০ টাকা দিয়ে একটা সাদা টি-শার্ট, যার পিছনে লেখা পুরী, জয় জগন্নাথ আর সামনে তিনজনের ছবি। কিন্তু এই টি-শার্ট পরে ঘুরে বেড়ানোর সাহস হল না। 

আরও পড়ুন

Advertisement

স্বর্গোদ্বারে একের পর এক মন্দির। পঞ্চমুখী মহাদেবের মন্দির। এইরকম মূর্তি দেখা যায় না। অখণ্ড স্তোত্র পাঠ হচ্ছে। নানা দেবদেবীর ছবি, মূর্তি। তার মধ্যে দেখলাম, অজানা এক দেবীর ছবি। জিজ্ঞাসা করলাম, ইনি কোন দেবী? জানতে পারলাম, এই দেবীর নাম মঙ্গরা দেবী। জানি না এই মঙ্গরা দেবীর স্বরূপ। ছবিতে দেখলাম, দেবী চতুর্ভূজা। এখনও হেঁটে চলেছি। হঠাৎ দেখছি, তন্তুশ্রীর দোকান। তবে বাঙালিদের ভিড় তুলনামূলক ভাবে অনেক কমে গেছে। আর বাংলায় লেখা সাইনবোর্ডের সংখ্যাও কম। কোথাও একটা বাঙালি সম্পর্কে এখানে অজানা বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। এটি শুভ সংকেত নয়। জানি না, এর সমাজতাত্ত্বিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষিত কী। তবে চোখে পড়ার মতো বিষয় এটি। রথযাত্রার সময় সেই বাংলায় লেখা ‘দাদা-বৌদি রেস্টুরেন্ট’ স্বর্গদ্বারে এখনও আছে। ভারত সেবাশ্রম সংঘ আছে। বাঙালি গেস্ট হাউস সমুদ্রের কাছেই আছে। বাঙালি উৎকল তন্তুজ অফিস সেবাশ্রম সংঘের কাছেই। সেখানে বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড আর উড়িয়ায় লেখা সাইনবোর্ড পাশাপাশি। তারই নিচে দাদা-বৌদি রেস্টুরেন্ট। এখনে বেঙ্গলি-ইন্ডিয়ান-চাইনিজের সঙ্গে লেখা আছে, বিরিয়ানি পাবেন। 

এখানে অনেক দোকানে বাংলায় লেখা আছে, চাউমিন আর চিল্লি চিকেন। চিলি চিকেন নয় কিন্তু। বানানটা দর্শনীয়। ওড়িয়া ভাষার প্রভাব কিনা জানি না। স্বর্গদ্বারে দেখলাম, উদাসীন সম্প্রদায়ের বাবলি মঠ। সেখানে ভাসুর-ভাদ্রবউ কুয়া নামে একটি বিখ্যাত কুয়া আছে। সেটা দেখতে লোকজন সেই মন্দিরে প্রবেশ করেন। নানা রকমের পুরাণের কাহিনি থেকে শুরু করে একটা প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর, ঠিক যেমনটি বারাণসী। তবে বেশিরভাগ হোটেলই তো জগন্নাথ দেবের নামে হয়। স্বর্গদ্বারে একটা বিরল হোটেল পেলাম। যার নাম দ্রৌপদী হোটেল। সাধারণত দ্রৌপদী নাম রাখার প্রবণতা তো দেখা যায় না। হাঁটতে হাঁটতে আমরা সমুদ্রে পৌঁছলাম। মন্দির থেকে সমুদ্রে এলে মনে পড়ে যায় এইরকমই নিকষ কালো, অন্ধকার সমুদ্রে কোনও একদিন শ্রী চৈতন্যদেব বিলীন হয়ে গিয়েছিলেন।

Advertisement