তখন ভোর ৫টা। আজ আমরা ভোরবেলায় একটা টেম্পো নিয়ে হোটেল থেকে চলে গেলাম মহাপ্রভুর মাসীর বাড়ি। কিন্তু চারদিকে পুলিসের ব্যারিকেড। তাই অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হল। আজ মাসীর বাড়ির সামনেই বলরাম, সুভদ্রা এবং প্রভু জনন্নাথের তিনটি রথ দাঁড়িয়ে আছে। শ্রী জগন্নাথ মন্দিরের পরেই গুরুত্বের বিচারে শ্রী গুন্ডিচা মন্দিরের স্থান। এই মন্দিরেও বিমান, জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও প্রভু মণ্ডপ রয়েছে। গুন্ডিচা মন্দির বড় দণ্ডর শেষ সীমায় অবস্থিত। বড় মন্দির থেকে এর দূরত্ব প্রায় তিন কিলোমিটার। এখানে দেবী সত্যবতী পূজিত হন।
গুন্ডিচা মন্দিরকে অনেকেই জগন্নাথ দেবের মাসীর বাড়িই বলে। কিন্তু এই তথ্যটা অনেকে আবার বলেন সঠিক নয়। জগন্নাথের মৌসীমা অর্থাৎ মাসীমার বাড়ি বলতে অর্ধাসনী দেবীর মন্দিরকে বলা হয়। অর্ধাসনী দেবী হলেন জগন্নাথের মাসীমা। মহাপ্রলয়ের সময় এই দেবী শ্রীক্ষেত্রের অর্ধেক জল শোষণ করেছিলেন বলে তাঁকে অর্ধশোষণী বা অর্ধাসনী বলা হয়। এই মন্দিরটি বড় দান্ডের ওপর অবস্থিত। যাই হোক, গুন্ডিচা মন্দিরের প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। অত ভোর বেলাতেও পৌঁছে মনে হচ্ছে, দেরি হয়ে গেছে। আমাদেরও আগে কত ভোর রাত থেকে মানুষ এসেছে। ওখানেও কিন্তু অস্থায়ী থাকার শিবির তৈরি হয়েছে। আর এই সমস্ত মানুষ, তাদের লক্ষ্য একটাই— রথের সামনে দাঁড়িয়ে দু’হাত তুলে জয়ধ্বনি দেওয়া— ‘জয় জগন্নাথ!’ এই মন্দিরের চারদিকে বহু মানুষ— তারা প্রদীপ বিক্রি করছে। ছোট ছোট মাটির প্রদীপ। ঘি মাখানো সলতে। আর সলতের মাথায় একটু করে কর্পুর লাগিয়ে দেওয়া। একটা ছোট প্রদীপ পাঁচ টাকা দাম। বহু মানুষ এই প্রদীপ কিনছে এবং ওই রথের সামনে ভূমিতে রাখছেন। বহু মানুষ জগন্নাথকে রেখে সেলফি তুলতেও ব্যস্ত। বিশেষত অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা। এমনকি বহু পুলিসকেও দেখলাম, তারা কাজ করতে করতেও সেলফি তুলে নিচ্ছে চটপট।
এবার গুন্ডিচা মন্দিরের কথা বলি, প্রায় সাত একর জায়গা জুড়ে এই মন্দির। তবে মূল মন্দিরটা ছোট। তার চারদিকে নারকেল গাছ আছে। মন্দিরের একটা বিরাট বাগান আছে। গুন্ডিচা মন্দিরের যে প্রবেশ পথ, সেটা ছাড়াও ওখানে আর একটা প্রবেশ পথ আছে। কিন্তু রথযাত্রার সময় যে প্রধান দ্বার দিয়ে জগন্নাথ দেব, বলভদ্র এবং সুভদ্রা মন্দিরে প্রবেশ করেন। আমরা এই মন্দিরের প্রভুর প্রবেশের আগে তাঁকে দর্শন করলাম। এখন সাতদিন রত্নবেদিতে অবস্থানের পর হবে উল্টোরথ যাত্রা। তখন অন্য দ্বার দিয়ে তিনি বেরোবেন।
অনেকেরই ধারণা এবং কিংবদন্তী অনুযায়ী স্বয়ং বিশ্বকর্মা বৃদ্ধ ছুতোরের ছদ্মবেশে এসে দরজা বন্ধ করে জগন্নাথদেব বলভদ্র ও সুভদ্রার অর্ধসমাপ্ত দ্বারবিগ্রহ গুলির নির্মাণ করেছিলেন পুরীর বড় মন্দিরেই। তবে অনেকে আবার বলেন যে, তখন তো বড় মন্দির হয়নি। এই দ্বারবিগ্রহ গুলি গুন্ডিচা মন্দিরেই আসলে নির্মাণ হয়েছিল। জগন্নাথ মন্দির নির্মাণের পর কালক্রমে এই দ্বারবিগ্রহটি সেখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন।
তবে এই গোটা ব্যাপারটির পিছনেও একটি কিংবদন্তি লুকিয়ে আছে। যে কিংবদন্তি বহুবার আমাদের শোনা। কিন্তু আজ আবার একবার মনে করা যেতে পারে। সে হল, সত্য যুগের কথা। মালব রাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন পরম বিষ্ণুভক্ত। একদিন এক সন্ন্যাসীর কাছে তাঁর তীর্থভ্রমণের গল্প শুনলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। সন্ন্যাসী ভারতের নান তীর্থক্ষেত্রের বর্ণনা দিয়ে রাজাকে শ্রীক্ষেত্রের কথাও বললেন। শ্রীক্ষেত্রের নীল পাহাড়ে ভগবান বিষ্ণু নীলমাধব হয়ে শবরদের দ্বারা গুপ্তভাবে পুজিত হচ্ছেন এবং তিনি সাক্ষাৎ মুক্তিপ্রদায়ক। এইসব শুনে এই বিষ্ণুমুর্তি চাক্ষুষ করার জন্যে তখন ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। রাজা তাঁর পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে এই দেবতার সন্ধানে পাঠালেন। তিনি তো পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে এলেন। শবরদের রাজা বিশ্বাবসুর সঙ্গে দেখা করলেন। নীলমাধবকে দর্শন করার সুযোগ পেলেন। বিদ্যাপতির কাছ থেকে খবর পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে আসার জন্য তৈরি হলেন। আর ঠিক সেই সময় ব্রহ্মার আদেশে দেবর্ষি নারদও রাজাকে সাহস জোগানোর জন্য মর্ত্যে চলে এলেন। ইন্দ্রদ্যুম্ন নিজের পরিবারের সবাইকে নিয়ে, নিজের সৈন্য সামান্তদের নিয়ে নারদের সঙ্গে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে তো পৌঁছলেন। কিন্তু যখন তিনি নীলমাধব দর্শনের ইচ্ছে প্রকাশ করলেন, শুনতে পেলেন— নীলমাধব মুর্তি হঠাৎ হারিয়ে গেছে। অর্থাৎ অন্তর্ধান! শবর রাজ সেখানে কোনও গোপন স্থানে তাঁকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। এটাও আর একটা মত রয়েছে এই ঘটনাটি সম্পর্কে।
যাই হোক, নীলমাধবকে না দেখতে পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন খুব ভেঙে পড়লেন। তিনি ঠিক করলেন যে, আমি অনশন করে প্রাণত্যাগ করব। কুশ-শয্যায় শয়ন করলেন। নারদ তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, এখানে প্রভু জগন্নাথ দারুব্রহ্ম রূপে পুজো পাবেন— এ কথা ব্রহ্মা তাঁকে বলে পাঠিয়েছেন। নারদের কথা শুনে ইন্দ্রদ্যুম্ন আশ্বস্ত হলেন। এইভাবে নানা ঘটনার ঘনঘটার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত রাজা সফল হলেন। জগন্নাথের মূর্তি তৈরি হল এবং গুন্ডিচাতেই সেই মূর্তি স্থাপন হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। মতান্তর যাই থাক, মূর্তি তৈরি হল। সে এক দীর্ঘ কাহিনি!
আজ রাত পর্যন্ত মানুষের সমাগম। এবার প্রভু বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করবেন।
চলবে...