গুন্ডিচার মন্দিরে মহাপ্রভু জগন্নাথ দেব অধিষ্ঠিত। তাঁর সঙ্গে অবস্থান করছেন দাদা বলভদ্র এবং বোন সুভদ্রা। রথ থেকে অবতরণ করার সময় দাদার দারু-মূর্তি টানাপোড়েনে ভূপতিত হতে হয়। আজ সারাদিন ধরে তা নিয়ে চলছে নানা রকমের জল্পনা-কল্পনা। আহত হয়েছেন সেবায়েতরা অনেকে। একজনের পা ভেঙে গিয়েছে। কারও হাতের হাড় ভেঙেছে। কিন্তু সবার মুখে মুখে আলোচনা— কেন এমন হল? কার পাপে বলরাম এমন শাস্তি পেলেন? আজ অবশ্য রাত পর্যন্ত মন্দির খোলা। এই মন্দিরে যেহেতু এখন প্রভূ অবস্থান করছেন, সেই কারণে মূল ভিড়টা আজ এখানেই। মহাপ্রভুকে দর্শন করার জন্য বিরাট লাইন! সেই মন্দিরের ভিতর তাঁরা দর্শন দিচ্ছেন ভক্তদের। আর মন্দিরের দ্বৈতাপতি সেবায়েতরা ভোগ দিচ্ছেন। আজ জগন্নাথ দেবের প্রথম ভোগ। মন্দির প্রাঙ্গণের মেঝেতে বসে হাজার হাজার মানুষ ভোগ খাচ্ছেন। দ্বৈতাপতি সেবকরাই আজ ভোগের প্রধান আয়োজক।
শ্রীজগন্নাথ মন্দিরে সুয়ার ও বড় সুয়ার বলতে, সুপোকার ও প্রধান সুপোকারদের বোঝায়। কী ধরনের ভোগ তারা রান্না করেন, তা দিয়েই এই রাঁধুনিদের পরিচিতি। বড় সুয়াররা জগন্নাথ দেবের কোঠভোগ রান্না করেন। আর সুয়াররা ছত্রভোগ রান্নার দায়িত্বে থাকেন।
দ্বৈতাপতি সেবকরা কিন্তু ব্রাহ্মণ নন। তবে তাঁদের অসীম ক্ষমতা। জগন্নাথ দেবের মহাস্নান পূর্ণিমা থেকে রথযাত্রা পর্যন্ত প্রায় এক মাস দ্বৈতাপতি সেবকরাই জগন্নাথ দেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার পূজো-অর্চনা করেন। স্বয়ং জগন্নাথ শবর রাজা বিশ্ববসু ও ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতির বংশধরদের ভবিষ্যতে তাঁর সেবায় নিযুক্ত করার জন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে আদেশ দেন— এরকম কথাই স্কন্দপুরাণে লিপিবদ্ধ আছে। দেউলতোলা অনুযায়ী দ্বৈতাসেবকরা শবরদের বংশধর। জগন্নাথ দেবের এই মূর্তিটিকেও শবরমূর্তি বলা হয়। অর্থাৎ, তিনি ছিলেন ট্রাইবাল দেবতা। দ্বৈতা শবদটির অর্থ কী? এর দু’রকমের উৎপত্তি শোনা যায়। ‘দ্বৈত’ শব্দের অপভ্রংশ থেকে দ্বৈতা। দ্বৈত মানে ভিল বা শবর শ্রেণির মানুষদের বলা হত দ্বৈত। আবার সংস্কৃত শব্দ ‘দ্বৈত’ মানে প্রিয়। এই ‘দ্বৈত’ থেকেই হয়তো দ্বৈতা শব্দটি এসেছে। পতি মহাপাত্ররা বিদ্যাপতির বংশধর। অনবসর ও নবকলেবরের সময় দ্বৈতাপতিদের সতন্ত্র অধিকার, তারা জগন্নাথ দেবের আত্মীয় হিসেবে পরিচিত।
শ্রীজগন্নাথ দেবের মন্দিরের দ্বৈতাপতি, সেবায়েত বলছিলেন, স্নানযাত্রার পর জগন্নাথ দেবের ১৫ দিন যখন জ্বর হয়, তখন আমরাই তাঁর সেবা-পুজো করি। একে অনবসর বলে। আমাদের কিছু কিছু গুপ্তসেবাও করতে হয়। পুরনো বস্ত্র পাল্টে জগন্নাথ দেব, বলভদ্র ও সুভদ্রার অঙ্গে নতুন বস্ত্র আবৃত করা হয়। দারু-বিগ্রহ গুলো নতুন রং করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রার নবযৌবন লাভ হয়। এই কাজগুলি দ্বৈতাপতিরাই করেন। জগন্নাথ দেব নবযৌবন পাওয়ার পর তাঁর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা ও সুদর্শনকে রথে তোলার দায়িত্ব থাকে দ্বৈতাপতিদের। তবে এই কাজে প্রয়োজন হলে অন্য পাণ্ডারাও সহযোগিতা করেন।
আজ সারাদিন ধরে মন্দিরে ভোগপ্রসাদ বিতরণ হয়েছে। অসম্ভব স্বাদ সেই প্রসাদের! মহাপ্রভুর আশীর্বাদ ধন্য ভালবাসার সেই প্রসাদ মানুষ উপভোগ করেছেন। তাতে অন্নভোগ এবং বিশেষ প্রসাদ থাকে। তার সঙ্গে থাকে ডাল-সবজি। আর সবার প্রথমে দেওয়া হয় আমের চাটনি। একজন ভক্ত বলছিলেন, এই চাটনি প্রথমে খেতে হয়। তারপরে মূলভোগ খেতে হয়। এটাকে ঠাট্টা করে বলছিলেন যে, এটা হল এক ধরনের অ্যাপেটাইজার। প্রভু আমাদের নৈশভোজের আগে চাটনির অ্যাপেটাইজার দিয়ে খাওয়া শুরু করতে বলছেন। দর্শনের জন্য একেবারে চিঁড়ে চ্যাপটা ভিড় ছিল। কিন্তু বেশ সুশৃঙ্খল ছিল আজ। পুলিশও প্রচুর দেওয়া হয়েছিল। খোদ পুলিশ সুপার, তিনি নিজে এসে দ্বৈতাপতির সঙ্গে দেখা করলেন। সেখানে আয়োজনের কোনও ত্রুটি ছিল না।
এই গুন্ডিচা মন্দিরের কিছু আগে আছে গম্ভীরা। গম্ভীরায় শ্রীচৈতন্যদেব থাকতেন। সারারাত জেগে উচ্চ-সংকীর্তন করতেন। কৃষ্ণ প্রেমাবেশে দিনরাত কাটত শ্রীচৈতন্যের। তাঁর বাহ্যজ্ঞান থাকত না। একদিন কৃষ্ণ বিরহে ব্যাকুল হয়ে গম্ভীরার মেঝেতে মুখ ঘষতে লাগলেন। মুখ-গাল-নাক কেটে গিয়ে রক্তধারা বইতে লাগল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখেছেন, 'উন্মাদদশায় প্রভুর স্থির নহে মন। যে বলে, যে করে সব উন্মাদ লক্ষণ।' মহাপিঠস্থান গম্ভীরার পর আসছে মাসির বাড়ি গুন্ডিচা। মহা পিঠস্থান গুন্ডিচা ওড়িশার দেশজ শব্দ। কোনও বাড়ির ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ছোট ঘর থাকলে তাকে গম্ভীরি— এই নামে অভিহিত করা হত। গম্ভীরি থেকে গম্ভীরা শব্দটি এসেছে। এই গম্ভীরাই ছিল মহাপ্রভুর নিত্যলীলাস্থল। 'লীলা তু গম্ভীরা যত্র, গম্ভীরা সা নিগদ্বতে'। অর্থাৎ, যেখানে গোবিন্দের লীলা অতি গভীর এবং গম্ভীর হয়েছে, সেই স্থানই গম্ভীরা। বিপ্রলম্ভ দশায় সম্বক রস আস্বাদনের নিভৃত স্থান ছিল এই গম্ভীরা। মহাপ্রভুর নয়নের জলে বারংবার ভেসে গিয়েছে এই গম্ভীরা। প্রাণবল্লভ শ্রীগোবিন্দের ত্রিভঙ্গললিত সুঠাম মূর্তি তাঁর নয়নের জলে আঁকা হয়েছে অজস্রবার।
লেখক সুমন গুপ্তের বর্ণনায় শ্রীচৈতন্যদেবের মাহাত্ম্য উঠে এসেছে অসাধারণ দক্ষতায়। গম্ভীর প্রকোষ্ঠে নিনাদিত মহাপ্রভুর বিলাপধ্বনি। তা নিশিদের নিস্তব্ধতা ভেঙে সমগ্র বিশ্রামালয়টিকে মুখরিত করে তোলে। শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত থেকে জানা যায় সেই সব গানের কথা। এই গদাধর গুন্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্রই শত্রুরা ঘিরে ধরে তাঁকেও মেরে ফেলল। নয়তো আধমরা করে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে গেল মন্দিরেই কোনও গোপন স্থানে। নবাবীষ্কৃত বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্য ভাগবতে আছে— গদাধর জানিলেন প্রভুর গমন। প্রভুর বিরহে তাঁর না রহে জীবন। আচম্বিতে গদাধর হইল অন্তর্ধান। না পায় দেখিতে কেহ বলে রাম রাম! শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্য যুধিষ্ঠির জানা (মালিবুড়োর) সেই লেখা থেকে জানা যাচ্ছে যে, কাশীনাথ মিশ্রের গম্ভীরা থেকে অর্থাৎ, নির্জন ছোট ঘর থেকে পারিষদদের নিয়ে গুন্ডিচা বাটিতে জগন্নাথ দর্শন করতে চলেছিলেন প্রভু। তিনি ইতিপূর্বেই জানতে পেরেছিলেন, তাঁর অনুচরদের মধ্যে কে আছে গোবিন্দ বিদ্যাধরের চর। তাই সকলকে পিছনে ফেলে একাই আচম্বিতে ঢুকে পড়লেন মন্দিরে। গোবিন্দ বিদ্যাধরের চরেরা প্রস্তুত ছিল। তারা ঝা করে লাগিয়ে দিল কপাট। প্রভু দ্রুত চলেছেন জগন্নাথের দিকে এগিয়ে। তারপরের বিবরণ বৃন্দাবন দাস গোপন করেছেন। ওই যে পরিছাগণ বেত নিয়ে এগিয়ে চলল প্রভুর দিকে। কিন্তু নিস্তার দিল না পাণ্ডারা। প্রহারে প্রহারে জর্জরিত করে অচৈতন্য করল। প্রভু কিন্তু তখন সমাধিস্থ। পাণ্ডারা ভাবল, প্রভুর দেহে আর প্রাণ নাই। তাই তাড়াতাড়ি ধরাধরি করে প্রভুর অচৈতন্য দেহকে গুন্ডিচা বাটির গোপন কক্ষে লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু অম্বিকা ব্রহ্মচারীর আবিষ্কৃত এই পুঁথিতে গুন্ডিচা বাটির কথা নাই। আছে শ্রী দেউলে অর্থাৎ, মূল মন্দিরে।
এই চৈতন্যদেবের অন্তর্ধান রহস্য আজও রহস্যে মোড়া। তবে আজ রথযাত্রার এই পুণ্যদিনে মানুষ সেইসব ভুলে প্রভু জগন্নাথের আরাধনায় অনেক বেশি ব্যস্ত। এইভাবেই দিনটা শেষ হল। আমরা রাতের প্রসাদ নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের নিজস্ব হোটেলে।
তথ্যসূত্র: শ্রী জগন্নাথ দেবের অমৃতকথা, সুমন গ্রপ্ত।