এই বছর রথযাত্রা ৭ জুলাই। এইদিন ওড়িশা থেকে জগন্নাথ মহাপ্রভুর রথ বেরোবে। গত ১৫ দিন ধরে অসুস্থ মহাপ্রভু এবার সুস্থ হয়ে গিয়েছেন। এই ১৫ দিন তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকেন। এই একান্তবাসের সময় জগন্নাথ দেব কাউকে দর্শন দেন না। অনাসর একান্তবাসের সময় ভগবান জগ্নাথ দেবকে ফুলুরি তেল লেপন, ঘন-খালি প্রসাদ লাগি নীতি (মহাপ্রভুর শরীরে ঐশ্বরিক প্রলেপ লাগানো) করা হয়। তবে এই মহাপ্রভু জগন্নাথের সঙ্গে বাংলার রসগোল্লার যোগ নিবিড়।
রসগোল্লা ও রথযাত্রার সম্পর্ক নিবিড়। তবে এর পিছনে রয়েছে পৌরাণিক কাহিনী। কথিত আছে, রথযাত্রার শেষদিনে নাকি দেবী লক্ষ্মীকে জগন্নাথদেব রসগোল্লা খেতে দিয়েছিলেন। আর জগন্নাথ দেবের নির্দেশেই পুরীতে রসগোল্লা তৈরি হয়। আসলে রথযাত্রার শেষদিনে আষাঢ় মাসের শুক্লা ত্রয়োদশীতে নীলাদ্রি বিজয় উৎসবের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ‘রসগোল্লা উৎসব’। ত্রয়োদশীর দিন ভোগ হিসাবে জগন্নাথদেবকে কয়েকশো হাঁড়ি রসগোল্লা নিবেদন করা হয়। আসলে এই মিষ্টি উপহার দেওয়া হয় লক্ষ্মীদেবীকেই। লক্ষ্মীর মান ভাঙিয়েই তো ঘরে ফিরতে হবে প্রভু জগন্নাথকে। ত্রয়োদশীতে তাই রসগোল্লা উৎসবে মেতে ওঠে ওড়িশা। প্রতিবছর দাম্পত্যের এই মধুররসের সাক্ষী থাকে আপামর জনসাধারণ আর তা অনুষ্ঠিত হয় লক্ষ্মীদেবী ও জগন্নাথদেবের সেবাইতদের মাধ্যমে। বাঙালির এই প্রাণের মিষ্টি রসগোল্লাতেই প্রতিবছর রথযাত্রার মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মিষ্টিমুখে রথযাত্রা সমাপন।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, জ্বর থেকে সেরে ওঠার পর যখন প্রভু দগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, তখন লক্ষ্মীকে বলেছিলেন দুদিনের মধ্যে তাঁরা ঘুরে চলে আসবেন। কিন্তু দুদিনের মধ্যে তো প্রভু জগন্নাথ ফিরলেন না, এমনকী ৩-৪ দিনেও তাঁর দেখা পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত পঞ্চম দিনের মাথায় প্রভু জগন্নাথের খোঁজে বের হন দেবী লক্ষ্মী। যেহেতু দেবী লক্ষ্মী প্রভু জগন্নাথকে খুঁজতে পঞ্চমী তিথিতে বেরিয়েছিলেন, তাই সেদিনকে হেরা পঞ্চমী বলা হয়। কথিত আছে, প্রভু জগন্নাথ দেবের খোঁজে যখন দেবী লক্ষ্মী জগন্নাথের মাসির বাড়ি গুন্ডিচা মন্দিরে পৌঁছোন, তখন দেখেন প্রভু জগন্ন্থা সুভদ্রার সঙ্গে বসে মিষ্টি খাচ্ছেন। তখন তাড়াহুড়ো করে দেবী লক্ষ্মী মন্দিরে যখন ঢুকতে যান, সেই সময় নিরাপত্তারক্ষীরা মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেন। এর ফলে দেবী লক্ষ্মী আর গুন্ডিচা মন্দিরে ঢুকতে পারেননি। রাগে-দুঃখে প্রভু জগন্নাথের রথ ভেঙে দেন লক্ষ্মী এবং পালকি করে নিজের বাড়ি চলে যান।
মাসির বাড়ি থেকে ফিরলেও সহজে কিন্তু জগন্নাথদেব মূল মন্দিরে প্রবেশের অনুমতি পান না। কেননা মানিনী হয়েছেন স্বয়ং মা লক্ষ্মী। অগত্যা তিন ভাই বোন শ্রীমন্দিরের সামনে তিনদিন ধরে রথের উপরেই উপবিষ্ট থাকেন। এই তিনদিন একাধিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় রথযাত্রা উৎসব। তৃতীয় দিন জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা মন্দিরে প্রবেশ করতে গেলে ঘটে এক মজার কাণ্ড। বলরাম আর সুভদ্রার কপাল ভাল বলতে হবে। ভালয় ভালয় তাঁরা মন্দিরে প্রবেশ করেন। এদিকে তাঁদের পথ অনুসরণ করে যেই না জগন্নাথ ঢুকতে যাবেন, লক্ষ্মী দেবী সটান মুখের উপর দুম করে দরজা বন্ধ করে দেন। কারণ তিন ভাইবোন মাসির বাড়ি থেকে দেদার আমোদ-আহ্লাদ করে এসেছেন অথচ তাঁকে নিয়ে যাননি। অভিমানিনী লক্ষ্মী দেবী এই কয়দিন একা একা শ্রীমন্দিরে ছিলেন। অবশ্য মাঝখানে একদিন তিনি মাসির বাড়ি দেখা করতে গিয়েছিলেন কিন্তু জগন্নাথ তাঁকে যেন দেখেও দেখেননি। তারই ফলস্বরূপ যাত্রা শেষে জগন্নাথদেব দেখেন তাঁর জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ। অবস্থা বেগতিক দেখে স্ত্রীর মানভঞ্জনের জন্য বুদ্ধি করে এক হাঁড়ি রসগোল্লার আয়োজন করে জগন্নাথ। দেবী লক্ষ্মীর মান ভাঙে ওই রসগোল্লা খেয়েই। পরিতৃপ্ত হয়ে অবশেষে স্বামীকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দেন তিনি। খুশি মনে পতিদেবকে নিয়ে তিনি প্রবেশ করেন শ্রীমন্দিরে। এক বছরের মতো নিশ্চিন্ত, আর পতিদেব কাছছাড়া হবেন না। মন্দিরের সিংহদুয়ার এরপর বন্ধ হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, বাংলা ও ওড়িশা দুই জায়গাতেই রসগোল্লা সমানভাবে কদর পায়। দুই জায়গারই পরিচয়ের চিহ্ন বহন করে এই মিষ্টান্নটি। রসগোল্লা বাঙালি ও ওড়িয়া দুই জাতিরই ভীষণ প্রিয় একটি মিষ্টি। আর এই রসগোল্লা দুই রাজ্যের সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।