scorecardresearch
 

বাংলার নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোট কতটা ফ্যাক্টর? বিশ্লেষণে জয়ন্ত ঘোষাল

প্রশ্নটা ভারতের ইতিহাসের এক প্রায় সমাধানহীন রহস্য। ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পটভূমিতে মাত্র ৮০০ বা তারও কম সময়ের কথা। ভারতের প্রাচীন যুগ সম্পর্কে জানা যায় কম। কারণ অতীতে ভারতীয়রা ইতিহাস রচনায় সেভাবে আগ্ৰহ দেখায়নি। কিন্তু মুসলমানরা ইতিহাস সচেতন জাতি ছিলেন।

Advertisement
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হাইলাইটস
  • প্রশ্নটা ভারতের ইতিহাসের এক প্রায় সমাধানহীন রহস্য
  • উর্দুভাষী ইমামদের তুলনায় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়া
  • মুসলমানদের ভেতরেও এরকম অভ‍্যন্তরীণ লড়াই, কলহ সব রয়েছে

১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযায়ী অবিভক্ত ভারতে মোট মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৪,৩০,০৬,০০০। তার মধ্যে পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ বাংলার যে অংশ দেশভাগের পর পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানকার মুসলমান জনসংখ্যা ১,৯১,১৩,০০০। আর যে অংশ পশ্চিম-পাকিস্তানে যায়, পরে তার সংখ্যা ছিল ১,৩৯,০৪,০০০। এই পরিসংখ্যানে ওই সময় পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা আলাদা করে দেয়া নেই। তাহলেও এটা বুঝতে পারা যাচ্ছে, শুধু তখন নয়, আজকেও দুটো বাংলার মোট বাঙালি মুসলমান অবিভক্ত ভারতের বাকি অংশের সমস্ত মুসলমানের চেয়েও সংখ‍্যায় বেশি। তাহলে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশই হল পৃথিবীর চতুর্থ মুসলিম জনসংখ্যা বিশিষ্ট রাষ্ট্র। জাতিগত ভাবে মুসলিম জগতে তাই আরবের পরেই বাঙালি মুসলমানের স্থান। ভারত-পাক-বাংলাদেশ এই উপমহাদেশে প্রাদেশিক ভিত্তিতে পুর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে বাংলা মুসলমানের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি। অথচ একসময় দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়েই আরব, পাঠান, তূর্ক, মোঘল আক্রমণকারীরা ভারতে ঢুকে ছিল। বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন বংশীয় মুসলমান শাসকেরা রাজত্ব করেছে উত্তর-পশ্চিম ভারত এবং দিল্লিকে কেন্দ্র করে। আরব সেনানায়ক মহম্মদ বিন-কাসিম সিন্ধু জয় করেছিলেন আট শতকের দ্বিতীয় দশকে। আর বক্তিয়ার খলজি বাংলায় এসেছিলেন তেরো শতকের প্রথম দশকে। দুজনের মধ্যে প্রায় পাঁচশো বছরের ফারাক। তা সত্ত্বেও ভারতের বাকি অংশের তুলনায় বাঙালি মুসলমানের এই সংখ্যাধিক‍্য টা কী করে ঘটলো ? 

প্রশ্নটা ভারতের ইতিহাসের এক প্রায় সমাধানহীন রহস্য। ভারতের সুদীর্ঘ ইতিহাসের পটভূমিতে মাত্র ৮০০ বা তারও কম সময়ের কথা। ভারতের প্রাচীন যুগ সম্পর্কে জানা যায় কম। কারণ অতীতে ভারতীয়রা ইতিহাস রচনায় সেভাবে আগ্ৰহ দেখায়নি। কিন্তু মুসলমানরা ইতিহাস সচেতন জাতি ছিলেন। সময়ের বিচারে ভারতে মুসলমান শাসন অনেক পরের ঘটনা। এইভাবে বাংলায় ইসলামের প্রসার নানান রকম ভাবে ঘটেছে। বলপ্রয়োগ, রাজদরবারে উচ্চপদ পাওয়ার লোভ, সুফি সাধকদের প্রভাব, নিম্নবর্ণের ওপর ব্রাহ্মণদের অত‍্যাচার। কোনটাই কিন্তু বাংলার পরিস্থিতি বিশেষ ভাবে খাটে বলে অবশ্য অনেকে মনে করেননি। আসলে যেটা হয়েছে মার্কিন ঐতিহাসিক রির্চাড.এম. ইটোনো বলেছেন, যে আসলে মুসলমান সমাজের যে বিকাশ হয়েছে, সেই বিকাশটা দীর্ঘ মুসলিম শাসনের প্রভাব। এই মুসলিম শাসনের পর পশ্চিমবঙ্গে বহু বছর কেটে গেছে। 

Advertisement

দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের যে রাজনীতি, কেননা বাংলায় দুবার দেশভাগ হয়েছে। ১৯০৫ এবং ১৯৪৭। তারপর পশ্চিমবঙ্গে আজকে ২০২১ সালে যে মুসলিম জনসমাজ, তার মধ্যে একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িকতার সংঘাত ছিল। তার একটা অতীতের ইতিহাস ছিল। আবার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভালোবাসার ইতিহাসও কিন্তু রয়েছে। কলকাতায় উর্দুভাষী মুসলমান বেশি। বাংলায় কথা বলা মুসলমান কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বেশি। সুতরাং শতকরা ২৮ ভাগের মধ্যে ৮ ভাগ যদি উর্দুভাষী হয়। তাহলে ২০ ভাগ বাংলাভাষী। কিন্তু সংখ‍্যায় কম হলেও এই উর্দুভাষী মুসলমান কিন্তু অভিজাত শহুরে এবং কলকাতা কেন্দ্রীক। তার ফলে মুসলমান সমাজের ওপরে তাদের যে প্রভাব, সেটা সাংঘাতিক। কলকাতায় টিপু সুলতান মসজিদ থেকে শুরু করে নাখোদা মসজিদ থেকে শুরু করে তাদের যে ইমাম, এই ইমামতন্ত্রটা কিন্তু উর্দুভাষী মুসলমানদের দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত। আবার জেলায় জেলায় গ্ৰামে গ্ৰামে অনেক ছোট ছোট মসজিদ, যেগুলো বাঙালি মুসলমানদের। শুধু ফুরফরা শরিফ নয়। আরো অনেক মসজিদ, যেমন মালদা থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে এবং দক্ষিণবঙ্গেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের যারা ইমাম তারা

উর্দুভাষী ইমামদের তুলনায় আর্থ-সামাজিক দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে পড়া। কিন্তু মজার ব‍্যাপার হচ্ছে, যে ভারতীয় মুসলমান দের মধ্যে বাঙালি মুসলমান এবং বিহার, উত্তরপ্রদেশ, কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব এমনকি তামিলনাড়ু, কেরলের মুসলমানও কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করে। সুতরাং কলকাতার মুসলমানদের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সাংঘাতিক রকমের প্রবল‌। এই বৈচিত্র্যটা না বুঝতে পারলে মুসলমানদের ভেতরকার শ্রেণী সমাজটা বোঝা যায় না। মুসলমান সমাজের মধ্যেও অনেক শ্রেণী আছে। যেরকম সৈয়দ যারা বা সইদ তারা বিভিন্ন মসজিদের মৌলবী, যাকে বলে পুরোহিত শ্রেণী বা ইমাম। কিছু কিছু ফল ব‍্যবসায়ী আছে অবিভক্ত ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে এসে ছিল। আবার আছে পাকতূন। এরা মূলত পাঠান। আওয়ান আছে যারা ফল ব‍্যবসায়ী। কাকাজাই আছে, যারা আফগানিস্তান থেকে এসেছিল। কালাল আছে, যারা ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত থেকে এসেছিল। তারা পরিবহনের পশু অর্থাৎ ঘোড়া-খচ্চর এসবের ব‍্যবসা করতো। কাশ্মীরি-পেশোয়ারী আছে। দাউদ দি বহোরা বা ইসমাইলি সিয়া, যারা গুজরাট, আমেদাবাদ এবং জামনগর থেকে ব‍্যবসার জন্য এসেছিল। ইমামী ইসমাইলি সিয়া, সুন্নি বোহোরা, মেমান, মেমন থাঙ্গল, মুসললিয়ার, রাওথের, কেয়ী, মারায়েকর, মাপিলা, রউথের, রাব্বাই, সৈয়দ, পাঠান, রাজপুত, মল্লিক নানান রকমের প্রকারভেদ আছে। এই যে মল্লিক এরা বিহারের মুসলমান। পাটনা, গয়া, মুঙ্গের, সাহাবাদ অঞ্চল থেকে এসেছে। সুতরাং আমরা যে সবসময় বলি, মুসলমানরা এককাট্টা হয়ে এনব্লক ভোট দিচ্ছে। সেটা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন আছে এটা কী সত্যি ? এখনো কী মুসলমানরা এককাট্টা হয়ে ইমামদের কথায় ভোট দেয় ? নাকি নানান রকমের মুসলমানদের মধ্যে নানান রকমের শ্রেণী আছে। যারা গুজরাটি মুসলমান তাদের কিছু নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দেন। সেটা ভয়ে হোক বা ভক্তিতে হোক। নিরাপত্তার অভাববোধে হোক। 

এইরকম ভাবে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান রা কী বিজেপির দিকে ঝুঁকতে পারে ? আমার অবশ্য কখনোই মনে হয়না যে মুসলমানরা বিজেপি কে কখনো ভোট দেবে বা দিতে পারে। এটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ঘটনা। কিন্তু মুসলমান সমাজে ভোট ভাগাভাগি হবে কিনা। তার কারণ সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেক‍্যুলার ফ্রন্ট যেটা ওয়েসি এবং সিদ্দিকী মিলে করেছে। তার কতটা প্রভাব পড়বে সেটা দেখার বিষয়। তবে একটা জিনিস খুব পরীষ্কার হায়দ্রাবাদে ওয়েসি যেভাবে দল গড়েছিল, ঠিক সেভাবে পশ্চিমবঙ্গে উর্দুভাষী মুসলমানদের ওপর সবটা নির্ভর করা যায় না জানতে পেরে তিনি কিন্তু সিদ্দিকীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটা যৌথভাবে ফ্রন্ট তৈরি করেছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিদ্দিকীকে আউটসোর্স করে দিয়েছে ওয়েসি। সিদ্দিকীর মাধ‍্যমে মূলত নির্বাচন টা লড়ছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত সেভাবে তাদের প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। আরেকটা মজার ব‍্যাপার হচ্ছে, ওয়েসি কলকাতার ইমামদের কাছে খুব জনপ্রিয় নয়। হায়দ্রাবাদে যেমন ওয়েসি কলকাতার ইমামদের ঢুকতে দেয় না। তেমনি কলকাতার ইমামরা ওয়েসি কে কলকাতায় ঢুকতে দিতে চায় না। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, তুমি ওখানে থাকো রাজত্ব করো। আর আমাদের এখানে রাজত্ব করতে দাও।

Advertisement

মুসলমানদের ভেতরেও এরকম অভ‍্যন্তরীণ লড়াই, কলহ সব রয়েছে। বাইরে থেকে যেটা সহজ মনে হয়। আসলে সেটা এতো সোজা নয়। এখন এই পরিস্থিতিতে এই ভোটাভুটিটা কী হয় ? মুসলমানদের ভোট ভাগাভাগি টা হয় কিনা। সিপিএম একদা কংগ্রেসের কাছ থেকে এই উর্দুভাষী মুসলমানদের সার্পোটটা নিয়ে নিয়েছিল। সিপিএম প্রয়াত স্পিকার আব্দুল হালিম উর্দুভাষী মুসলমান দের একটা সার্পোটবেস ছিলেন। তাঁর ছেলে এখন উর্দুভাষী মুসলমানদের ওপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। তিনি পেশায় চিকিৎসক। শহুরে মানুষ। আবার ববি হাকিম বা ফিরহাদ হাকিম খিদিরপুরে উর্দুভাষী মুসলমান দের নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি কিন্তু মমতার সবথেকে বড় মুসলমান ফেস হয়ে উঠেছেন। কিন্তু মমতা এবারে কৌশলগতভাবে ভাবে খুব বেশি তাঁকে সামনে না নিয়ে এসে হিন্দু-মুসলিম ভোট যাতে মেরুকরণ না হয়। যেটা বিজেপি চাইছে। তার জন্য মমতা সাবধানে পা ফেলছেন। খুব প্রকাশ‍্যে মুসলিম রাজনীতি তিনি করছেন না। এমনকি ববি কেও তিনি সেভাবে করতে দিচ্ছেন না। এই পরিস্থিতিতে মুসলমানরা যদি বিজেপির ভয়ে শঙ্কিত হয়ে এককাট্টা হয়ে মমতার দিকে যায়। তাহলে শতকরা ২৮-২৯ ভাগ ভোট মমতার করায়াত্ত থাকবে। কিন্তু তারপরে হিন্দু ভোটটা কী হবে সেটা অন্য প্রশ্ন। এখনো পর্যন্ত যা পরিস্থিতি তাতে মুসলমান ভোট মমতার দিকেই অনেক বেশি রয়েছে। একদা যে মুসলমানরা সিপিএমের দিকে চলে এসেছিল, তারাই এখন মমতার দিকে এসে গেছে। তারা মমতা কে ছেড়ে কোথায় যাবে ? বিজেপির দিকে যাওয়াটা কঠিন, সিদ্দিকীর দিকে যাওয়ার ইঙ্গিতও এখনো পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। শেষপর্যন্ত দেখতে হবে, এই ভোট সচল হয় মমতার দিক থেকে সিদ্দিকীর দিকে যায়, নাকি মমতার দিকেই থাকে।

 

Advertisement