জগদীপ ধনখড় বাংলায় আসার পর থেকেই রাজ্য-রাজ্যপাল দ্বৈরথ এরাজ্যে নতুন নয়। বারবার এরাজ্যে আইনের শাসন নেই বলে সোচ্চার হতে দেখা গেছে ধনখড়কে। এই নিয়ে সরকারি আধিকারিকদের রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষ থাকার ধমকও দিতে দেখা গেছে রাজ্যপালকে। এবার সরাসরি রাজ্য প্রশাসনের এক দুঁদে আইপিএস অফিসারকে নিশানা করেছেন রাজ্যপাল। দু'দিন হল সেই আইপিএ আধিকারিকে নিয়েই একের পর এক ট্যুইট করতে দেখা যাচ্ছে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে। আর সেই আইপিএস অফিসার আর কেউ নন, স্বয়ং এরাজ্যের এডিজি আইনশৃঙ্খলা জ্ঞানবন্ত সিং। কিন্তু বারবার কেন মমতা সরকারকে নিশানা করতে এই আইপিএস অফিসারের বিরুদ্ধে তোপ দাগছেন ধনখড়? অতীতে কিন্তু মমতা -জ্ঞানবন্ত আঁতাত নিয়ে সরব হয়েছিল বিরোধী শিবিরও।
রাজ্য পুলিশের দাপুটে পুলিশকর্তা জ্ঞানবন্ত সিং আর বিতর্ক যেন সমার্থক। ২০০৭ সালে রিজওয়ানুর রহমানের অপমৃত্যুর মামলায় নাম জড়িয়ে গিয়েছিল জ্ঞানবন্ত সিংয়ের। বাম জমানায় যেসব ঘটনা তৃণমূলের মাটি শক্ত করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল রিজওয়ানুর রহমানের অকাল মৃত্যু৷ তরুণ রিজওয়ানুরকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল কলকাতা পুলিশের যে পদস্থ অফিসারদের বিরুদ্ধে, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জ্ঞানবন্ত সিং।
২০০৭ সালের পুজোর মুখে উল্টোডাঙা স্টেশনের অদূরে কম্পিউটার গ্রাফিক্স ডিজাইনার বছর তিরিশের রিজওয়ানুরের দেহ মেলে৷ সেই সময় তাঁর পরিবারের তরফে অভিযোগ করা হয়, শিল্পপতি অশোক টোডির মেয়ে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে বিয়ে ভাঙতে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডিসি সদর জ্ঞানবন্ত এবং গোয়েন্দা প্রধান অজয় কুমার চাপ সৃষ্টি করেছিলেন৷ রিজওয়ানুরকে লালবাজারে ডেকে শাসানোও হয়৷ রিজওয়ানুরের পরিবার খুনের অভিযোগ করলেও সিবিআই তদন্তে জানা যায় তিনি আত্মহত্যাই করেছিলেন৷ তবে তাঁকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য অজয়কুমার এবং গোয়েন্দা বিভাগের দুই অধস্তন অফিসারের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার সুপারিশ করে হাইকোর্ট৷ সেইসঙ্গে কলকাতার তত্কালীন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় ও জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়৷ প্রসূন মুখোপাধ্যায় -সহ সব অভিযুক্ত অফিসারকেই তখন সরকার পদ থেকে সরিয়ে দেয়৷
সেই সময় বাম সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে রিজওয়ানুরের অকাল মৃত্যুকে হাতিয়ার করেছিল তৃণমূল-সহ বিরোধীরা৷ তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে এই ইস্যুতে যথেষ্ট বিপাকে ফেলে দেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ রিজওয়ানুরকাণ্ডে তাঁর নাম জড়ানোয় দীর্ঘদিন পদোন্নতি আটকে ছিল জ্ঞানবন্ত সিং-এর। ক্ষমতায় আসার পর জ্ঞানবন্ত সিংকে ‘ক্লিনচিট’ দেয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারই৷ পদোন্নতি ঘটিয়ে তাঁকে মুর্শিদাবাদের ডিআইজি করে পাঠানো হয়৷ তারপর থেকেই এই আইপিএস অফিসারকে নিয়ে বারবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিশানা করে এসেছে বিরোধী শিবির।
২০১১ সালে নদিয়ার চাপড়া বিধানসভা আসনে রিজওয়ানুরের দাদা রুকবানুরকে প্রার্থী করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। সেখান থেকে জিতেও আসেন রুকবানুর। অনেকেই মনে করেন, বাম-বিরোধী হাওয়ার সঙ্গে রিজ-কাণ্ডে তৈরি হওয়া সহানুভূতি একযোগে কাজ করেছিল মমতার পক্ষে। তবে একদা রিজওয়ানুরকে আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচনা দেওয়ায় অভিযোগের ইপিএস অফিসারের সঙ্গেই মমতা প্রশাসনের নৈকট্য তাই বিরোধীদের কাছে নতুন অস্ত্র হয়েছে। লোকসভা ভোটের পর বারাকপুরে তৃণমূল - বিজেপি সংঘর্ষের ঘটনায় তাই বারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মার ভূমিকার পাশাপাশি রাজ্যের এডিজি আইন-শৃঙ্খলা জ্ঞানবন্ত সিং-কে নিয়েও প্রশ্ন তোলে গেরুয়া শিবির।
এদিকে তৃণমূল জমানায় কিন্তু একের পর এক পদোন্নতি হয়ে চলেছে জ্ঞানবন্ত সিং-এর। উত্তরবঙ্গে ও পিশ্চমাঞ্চলের আইজি থেকে বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার হয়ে বর্তমানে জ্ঞানবন্ত সিং রয়েছেন এডিজি আইনশৃঙ্খলা পদে। আর মমতার অত্যন্ত প্রিয়পাত্র এই আইপিএস অফিসারকেই পুরনো মামলার প্রসঙ্গ টেনে নিশানা করেছেন রাজ্যপাল। বুধবারের পর শুক্রবারও রাজ্যপাল সরব হয়েছেন জ্ঞানবন্ত প্রসঙ্গে। ধনখড়ের অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশাসনিক রাজনীতিকরণ গণতন্ত্রের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক। এধরনের রাজনৈতিক আধিকারিকরা এমন একটি গোষ্ঠী তৈরি করেন যাঁরা পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহার করে রাজনৈতিক অভিসন্ধি পূরণ করতে পারেন। আর এই প্রসঙ্গেই এডিজি আইন শৃঙ্খলার পদপ্রাপ্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন রাজ্যপাল। রাজ্যপাল ট্যুইটে করেছেন, "আইপিএস জ্ঞানবন্ত সিংহের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রেক্ষিতে এর আগে আদালত জানিয়েছিল, তিনি পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার করে মানুষের জীবনযাপনের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছিলেন। যেটা সন্দেহজনক, তা হল, সরকার তাঁর বিরুদ্ধে তথ্য দিতে অস্বীকার করছে। এ নিয়ে আবারও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিস্তারিত তথ্য চাইছি।" বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠিও দিয়েছেন ধনখড়। ট্যুইটারে সেই চিঠি প্রকাশ্যেও এনেছেন। বাম আমলে যে পুলিশকর্তার বিরুদ্ধে একদা আন্দোলনে নেমেছিলেন তৃণমূলনেত্রী আজ তাকেই দাবার চালের পাল্টা ঘুঁটি হিসাবে মমতা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছেন রাজ্যপাল।