রাতের বেলায় বারবার ছটপট এবং বিরক্ত করায় ভর্তি থাকা এক রোগীকে খাটের সঙ্গে বেঁধে কষিয়ে চড় মারার অভিযোগ উঠল নার্সিংহোমের এক কর্মীর বিরুদ্ধে। তাতে মদত এবং উস্কানি দেওয়ার অভিযোগ ওই নার্সিংহোমেরই এক আয়ার বিরুদ্ধে। কলেজ স্ট্রিটের ওই নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মুচিপাড়া থানায় এমনই অভিযোগ দায়ের করেছেন রোগীর পরিবার। যদিও রোগীর পরিবারের তোলা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে মুচিপাড়া থানার পুলিশ। যদিও পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্তে গড়িমসি এবং নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে রোগীর পরিবার।
গত মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সেরিব্রাল অ্যাটাক হওয়ায় কলেজ স্ট্রিটের একটি নার্সিং হোমে ভর্তি হন আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকার রাজা রামমোহন রায় রোডের বাসিন্দা সুকুমার হালদার। তার পরিবার জানান, মধ্যরাতে আচমকা এসি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গরমে ছটফট করতে থাকেন সুকুমার বাবু। বারবার এসি চালাতে বলে এবং জলের দেওয়ার অনুরোধ করে ডাকাডাকি করায় ওই রাতের দায়িত্বে থাকা এক আয়া বিরক্ত হচ্ছিলেন। সুকুমার হালদার বলেন, "বারবার ওনাকে ডাকায় হঠাৎ করে রেগে যান। এরপরে ওপর থেকে একটি ছেলেকে ডেকে নিয়ে আসেন ওই আয়া। এরপর সেই ছেলেটি এলে দুজন মিলে আমাকে চাদর দিয়ে খুব জোরে খাটের সাথে বেধে ফেলে। তারপরে আমার হাত এবং পা বেঁধে ফেলা হয়, ওই ছেলেটি আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তোর বাড়ি কোথায়? আমি উত্তর দেওয়ায় পরই ওই কর্মী জোর গলায় বলে তুই বড্ড বিরক্ত করছিস, বলেই আমাকে খুব জোরে থাপ্পড় মারে। আমি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। সারারাত ভয়ে বউ এবং ছেলের নাম ধরে ডেকে চিৎকার করতে থাকি। গোটারাত আমি কাকুতি মিনতি করে বলি, আমি একজন রোগী আমাকে কেন তোরা মারছিস, আমি মরেই যাব! যদিও তাতে আমার ডাকে কেউ সাড়া দেয়নি। অবশেষে সকালবেলায় একজন অল্পবয়সী নার্স এসে আমার এই অবস্থা দেখে তিনি হাত পা খুলিয়ে দেন এবং ওদেরকে বকাবকি করেন"।
সুকুমার বাবুর ছেলে সঞ্জয় হালদার বলেন, "সকাল বেলা বাবাকে দেখতে গেলে তিনি আমাদেরকে কাছে পেয়েই কান্নাকাটি জুরে দেন এবং বলেন আমাকে এখান থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে চল, ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। তখনই বাবার কাছ থেকে গোটা বিষয়টি আমরা জানতে পারি। আমরা দ্রুত নার্সিংহোম এর ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাই, এর পরে তিনি পাঁচ মিনিট পরে আসুন বলে দেড় ঘন্টা পরে আমাদেরকে সিসিটিভি ফুটেজ দেখান। সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এক হাসপাতাল কর্মী এবং ওই আয়া বাবার হাত পা বাঁধছে, যদিও ওরা চড় মারার দৃশ্যটি কেটে দিয়েছিল ওই দেড় ঘণ্টা সময় নেওয়ার সুযোগে। এরপরই আমরা বাবাকে ওই নার্সিংহোম থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে হাওড়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, উপকার নার্সিং হোমের চিকিৎসাতেও কিছু ত্রুটি ছিল।" এরপরেই মুচিপাড়া থানায় ওই নার্সিংহোমের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করে সুকুমার হালদারের পরিবার। তবে দেড় মাস কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ রোগীর পরিবারের। সুকুমারবাবুর ছেলে জানান, "ঘটনার দিন নার্সিংহোমে এসে বাবার বয়ান রেকর্ড করেছিলেন মুচিপাড়া থানার এক অফিসার। এরপরে আমাদের বাড়িতে এসেও আর এক অফিসার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। আমি সেই সময় মোবাইলে ভিডিও করছিলাম, তা দেখতে পেয়েই ওই অফিসার আর কিছু না বলেই আচমকা উঠে আমাদের বাড়ি থেকে চলে যান"। সুকুমার বাবুর এক পারিবারিক বন্ধু জানান, "বর্তমান রাজ্য সরকারের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, আমাদের বিশ্বাস আমরা বিচার পাবই কিন্তু পুলিশ তদন্তকে হালকা করার চেষ্টা করছে। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য কমিশনেও অভিযোগ জানাবো"।
এদিকে রোগীর পরিবারের তোলা সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ। ওই নার্সিংহোমের ম্যানেজার বলেন, "বহু রোগীই বেশি ছটফট করলে অনেক সময় তার সুরক্ষার কারণেই রোগীর হাত-পা আমরা বাঁধতে বাধ্য হই যাতে তিনি পড়ে গিয়ে নতুন করে চোট না পান। এটা নতুন কিছু নয়, কিন্তু ওই রোগীকে কেউ চড় মারেনি। এটা মিথ্যে অভিযোগ"। যদিও সেই রাতের সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে চাইলে তারা তা দেখাতে অস্বীকার করেন। ওই ম্যানেজার জানান, থানা থেকেই সিসিটিভি ফুটেজ দেখাতে নিষেধ করা হয়েছে। নিষেধাজ্ঞা রয়েছে নার্সিংহোম মালিকের তরফেও। প্রশ্ন উঠছে, যদি তারা নির্দোষ হন, তাহলে সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ্যে আনতে এত বাধা কোথায়? সেই রাতে রোগীর ওপর যদি কোনও অত্যাচারই না হয়ে থাকে, তাহলে সংবাদমাধ্যমের হাতে সিসিটিভি ফুটেজ এলে আপত্তি কোথায়? উত্তরে মুখে কুলুপ এঁটেছে নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ।